‘হরি ঘোষের গোয়াল’ – বহুল প্রচলিত প্রবাদের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মানুষটিকে চেনেন?
নিউজ ডেস্ক,দৃষ্টিভঙ্গি: হরি ঘোষের গোয়াল প্রবাদের উৎপত্তি নিয়ে দুটি কিংবদন্তি রয়েছে, প্রথমটি লেখক শ্রীঅশ্বঘোষ মতানুযায়ী, ‘হরি ঘোষের গোয়াল’ প্রবাদটির জন্ম নবদ্বীপে। নবদ্বীপের হরি ঘোষ নামের এক জমিদার তাঁরই গ্রাম নিবাসী শাস্ত্রজ্ঞ রঘুনাথ শিরোমণিকে তাঁর বাড়ির গোয়ালে টোল খুলে অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এই থেকেই প্রবাদটি বাংলায় এসেছে।
কিন্তু দ্বিতীয়ক্ষেত্রে রাধারমণ মিত্রের কলিকাতা দর্পণ অনুযায়ী, হরি ঘোষের থাকতেন কলকাতায়। তিনি ছিলেন মুঙ্গের দুর্গের দেওয়ান এবং কর্মজীবনে তিনি বিপুল পরিমান অর্থ উপার্জন করেছিলেন। অবসর নেওয়ার পর তিনি কলকাতায় চলে আসেন এবং বাড়িও তৈরী করে ছিলেন কলকাতায়। বহু অনাথ, দুঃখী, নিঃসম্বল লোককে, ছাত্র ও আত্মীয়স্বজনকে তিনি তাঁর বাড়িতে রাখতেন এবং তাঁদের খাওয়া-দাওয়া, আশ্রয় ও অন্নবস্ত্র দিয়ে সব রকম ভারই তিনি নিতেন । তাই লোকে চলতি কথায় তাঁর বাড়িটিকে ‘হরি ঘোষের গোয়াল’ বলত, যেহেতু দিনরাত এতো লোকের আনাগোনা চলত। তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তটির নাম এখনও হরি ঘোষ স্ট্রিট।
শ্রীঅশ্বঘোষ লিখেছেন, হরি ঘোষ মধ্যযুগের নবদ্বীপের কোনো একটি গ্রামের জমিদার ছিলেন। রঘুনাথ সেই গ্রামেরই দরিদ্র এক ব্রাহ্মণ সন্তান। কিন্তু শ্রী অশ্বঘোষ কোনো নির্দিষ্ট গ্রামের নাম উল্লেখ করেননি। তবে লেখকের মতে, রঘুনাথ নবদ্বীপের কোনও গ্রামের অর্থাৎ নবদ্বীপেরই মানুষ, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
আবার অন্য একটি মতে, রঘুনাথ সিলেট ( অধুনা বাংলাদেশ) জেলার পঞ্চখণ্ড নামক স্থানে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে (আনুমানিক ১৪৭২-৭৩ সালে) জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতার নাম গোবিন্দ চক্রবর্তী এবং মাতার নাম সীতাদেবী। অল্প বয়েসেই রঘুনাথ পিতৃহীন হন। রঘুনাথের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রঘুপতি সিলেট জেলার ইটার রাজা সুবিদ নারায়ণের কন্যাকে মাতার অমতে বিয়ে করেছিলেন। সেই কন্যা খোঁড়া ছিলেন।
এই বিবাহে ক্রুদ্ধ হয়ে মাতা সীতাদেবী কনিষ্ঠ পুত্র রঘুনাথকে নিয়ে জন্মভূমি সিলেট ত্যাগ করে নবদ্বীপ চলে যান। সেখানে বিখ্যাত পণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌম মহাশয়ের দয়ায় তাঁর বাড়িতে আশ্রয় লাভ করেন। সার্বভৌম মহাশয়ের টোলেই রঘুনাথের বিদ্যাশিক্ষা আরম্ভ হয়। কিছু দিনের মধ্যেই সার্বভৌম মহাশয়ের পরামর্শে রঘুনাথ মিথিলায় গিয়ে পণ্ডিতশ্রেষ্ঠ পক্ষীধর মিশ্রের কাছে ন্যায়শাস্ত্র পড়া আরম্ভ করেন। অল্পকাল পরেই শিরোমণি উপাধি লাভ করেন এবং গুরু পক্ষীধর মিশ্রকে শাস্ত্রীয় বিচারে পরাজিত করে ভারত বিখ্যাত নৈয়ায়িক রঘুনাথ শিরোমণি মিথিলাতেও নবদ্বীপের প্রাধান্য স্থাপন করেন। মিথিলার পাঠ শেষ করে রঘুনাথ শিরোমণি নবদ্বীপে ফিরে আসেন এবং হরি ঘোষ মহাশয়ের সাহায্যে নবদ্বীপে চতুষ্পাঠী স্থাপন করে অধ্যাপনায় রত হন।
প্রসঙ্গত, সেই যুগে মিথিলায় পড়াশোনা করলেও ওখান থেকে কোনও পুস্তক নিয়ে আসা যেত না। রঘুনাথ সমগ্র ন্যায়শাস্ত্র কণ্ঠস্থ করে নিয়ে আসেন এবং নিজের প্রখর স্মৃতিশক্তির সাহায্যে ন্যায় শাস্ত্রের গ্রন্থ রচনা করেন। সে যুগে নবদ্বীপে ন্যায়ের উপাধি পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল না। রঘুনাথ নবদ্বীপ থেকে ন্যায়ের উপাধি পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। ষোড়শ শতাব্দীর কোনও এক সময় ভারত বিখ্যাত শ্রীহট্টের পণ্ডিত রঘুনাথ শিরোমণি দেহরক্ষা করেন।
কলকাতার হরি ঘোষ স্ট্রিটের হরি ঘোষের বাড়িতে বহু অনাথ, দুঃখী, নিঃসম্বল মানুষ জন থাকতেন। তখন কলকাতায় অনেক দানশীল লোকের বাড়িতেই এমন লোকেরা থাকতেন। এই এতো লোকের থাকার ব্যাপারটিকে ঠাট্টা করে, রূপকার্থে গোয়াল বলা হতেই পারে। কিন্তু নবদ্বীপের ক্ষেত্রে, গোয়ালটি একেবারে আক্ষরিক অর্থেই সত্যি। একটি প্রবাদে দুটি ঘটনা থেকে উৎপত্তি লাভ করতেই পারে, এবং সেটি কখনই বিচিত্র নয়।
এইখানেই শেষ নয়, বিতর্ক রয়েই যায়। রঘুনাথ শিরোমণি যে শ্রীহট্টের রঘুপতির ভাই, এ নিয়ে কিন্তু কোনো প্রমাণ মেলেনি। শ্রীহট্টের বিখ্যাত পণ্ডিত পদ্মনাথ বিদ্যাবিনোদ এ কথা মানেননি। শ্রীহট্টের রাজা সুবিদনারায়ণ এবং রঘুনাথ শিরোমণি যে সমকালীন নন, এ নিয়ে ফণিভূষণ তর্কবাগীশ তাঁর ‘ন্যায়পরিচয়’ বইয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অধ্যাপক ড্যানিয়েল ইঙ্গলসও তাঁর ‘মেটিরিয়াল্স ফর দ্য স্টাডি অব নব্যন্যায় লজিক’ বইয়ে রঘুনাথের জন্মস্থান হিসেবে নবদ্বীপের কথাই লিখেছেন।