বাঙালির জাতীয়তাবাদ নিয়ে বর্তমানে গলা চড়াচ্ছে কারা?
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: বাঙালি নোবেল এনেছে, দেশকে অস্কার এনে দিয়েছে কিন্তু তাও বঙ্গবাসীর পরিচয় আটকে থেকেছে রসগোল্লা, আমি তোমাকে ভালবাসি আর বোরোলিনের মধ্যে। বাঙালি এতেই খুশি ছিল, হ্যাঁ ছিল। যে বাংলা ছিল সমৃদ্ধির আঁতুড়ঘর, কৃষ্টি-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র সেই বাংলাকে আস্তে আস্তে দৈন্য বাংলায় পরিণত করা হল। মতিলাল শীল, রামদুলাল দে সরকার, শিবকৃষ্ণ দাঁ-দের স্মৃতি ভুলিয়ে দাগিয়ে দেওয়া হল বাঙালি ব্যবসা পারে না। বাঘাসোম, নগেন্দ্রপ্রসাদের ধীরে ধীরে বাঙালির মন থেকে মুছে দেওয়া হল। হ্যারিসন রোড থেকে কলেজ স্ট্রিট, ফুটপাত থেকে গড়িয়া হাট, একদিন সব দখল হয়ে গেল। বাঙালিও তেমন ভেসে গেল, ক্যাব চালক থেকে ডেলিভারি বয়, মাল্টিপ্লেক্স থেকে মল সর্বত্র সে সবার সঙ্গে আধ ভাঙা হিন্দিতে কথা বলতে আরম্ভ করল। বাঙালির সুযোগ, বাংলার পাওনায়, জাঁকিয়ে বসল ভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ।
যে বাংলা ছিল স্বদেশী আন্দোলনের পীঠস্থান, সেই বাংলা কী করে ভুলে গেল জাতীয়তাবাদ? একটা জাতি দাঁড়িয়ে থাকে জাতিসত্ত্বা ও জাতীয়তাবাদের উপর, যখন সে জাতীয়তাবাদ ভুলে যায়; তখন সেই জাতির শিরদাঁড়া ভেঙে পড়ে। সেই সময় বাঙালিকে জাতীয়তাবাদ মনে করাতে হাজির হল গর্গ চট্টোপাধ্যায় ও বাংলা পক্ষ। সময়টা ছিল ২০১৮। বাঙালি বিপন্ন অনেকেই বলেন, বলেছেন কিন্তু বাঙালিকে নিজের অধিকার আদায় করে নিতে হবে এই আত্মোপলব্ধি করালো বাংলা পক্ষ। বাংলা পক্ষ মনে করে তাদের নেতৃত্বেই নিজেদের দাবিতে লড়াই করতে আরম্ভ করল বাঙালিরা। সরাসরি সংগ্রাম, বাঙালির অধিকারের দাবিতে ডেপুটেশন, বাংলা ভাষায় পরিষেবার দাবিতে আন্দোলন চলল বাংলা পক্ষের ব্যানারে। বাংলা পক্ষের দাবি, তাদের আন্দোলনের সূত্র ধরেই বাংলার মানুষ ভাবতে আরম্ভ করল, হ্যাঁ ঠিকই বাংলাটা বাঙালিরই। বাংলা পক্ষের দাবি অনুসারে তাদের প্রথম সাফল্য আসে যখন মেট্রোর স্মার্ট কার্ডে বাংলা লেখা আরম্ভ হয়। জানা যাচ্ছে, বাংলার প্রতিটি জেলায় তাদের সংগঠন তৈরি হয়েছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মদিনকে জাতীয় শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করার দাবি নিয়েও আন্দোলন করে চলেছে বাংলা পক্ষ।
২০১৯ সালে তৈরি হয় আরেক বাংলা জাতীয়তাবাদী সংগঠন, জাতীয় বাংলা সম্মেলন। তন্বী দাস, সিদ্ধব্রত দাস এবং আরও কিছু মানুষের নেতৃত্বে শুরু হয় আন্দোলন। বাঙালির অধিকারের দাবিতে লড়াই। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, শোনা যায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস এই একই নামের একটি জাতীয়তাবাদী সংগঠন তৈরি করেছিলেন। জানা যাচ্ছে, জাতীয় বাংলা সম্মেলন একেবারে শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থ রক্ষার্থে আন্দোলন আরম্ভ করে, আজও তাঁরা তা চালিয়ে যাচ্ছেন। উত্তরোত্তর তার পরিসর নাকি বাড়ছে। হকারদের দাবিতে লাগাতার লড়ে যাচ্ছেন জাতীয় বাংলা সম্মেলন, এরকমই দাবি তাদের। কেন্দ্র সরকার রেল বেসরকারিকরণের নামে বাঙালি হকারদের ভাতের থালায় লাথি মারছে, সেখানে রুখে দাঁড়াচ্ছে জাতীয় বাংলা সম্মেলনের হকার সংগঠন। জানা যাচ্ছে, আন্দোলন, অবরোধ ইত্যাদির মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষদের জন্যে লড়ছেন তাঁরা। ২০২০ সালে রবীন্দ্র সরোবরে ছট পুজো বন্ধ করা ছিল জাতীয় বাংলা সম্মেলনের অন্যতম বড় সাফল্য বলে মনে করে তাদের সমর্থকরা।
তবে ওয়াকিবহাল মহলে মনে করা হচ্ছে, বাংলা পক্ষ ও জাতীয় বাংলা সম্মেলনের সবচেয়ে বড় সাফল্য হল ভূমিপুত্র সংরক্ষণ করার দাবি সাধারণ বাঙালির মননে গেঁথে দেওয়া। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূমিপুত্র সংরক্ষণ তাদের আন্দোলনের সাফল্যের অন্যতম নজির বলে দাবি তাদের। তবে আপাতভাবে দেখে মনে করা হচ্ছে, বাংলা পক্ষের লক্ষ্য হল শিক্ষিত উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে বাংলা জাতীয়তাবাদ পৌঁছে দেওয়া। তাঁরা সে কাজে বহুমাত্রায় সফল বলে মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে, আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি দেখে মনে হয়, জাতীয় বাংলা সম্মেলন অনেক বেশি করে সমাজের প্রান্তিক ও তথাকথিত নিম্নবিত্ত মানুষদের মধ্যে পৌঁছতে চাইছে। তাঁরাও সাফল্যের সঙ্গে পৌঁছচ্ছে, এমনটাই দাবি। তবে হাল আমল সমাজ মাধ্যমের যুগ, যেকোনও আন্দোলনকে এখন সমাজ মাধ্যম প্রভাবিত করে। সেক্ষেত্রে জাতীয় বাংলা সম্মেলনের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে বাংলা পক্ষ। অন্যদিকে জাতীয় বাংলা সম্মেলন নাকি মাঠে নেমে জনসমর্থন জোগাতে পেরেছে বলে দাবি।
বাংলা পক্ষ বা জাতীয় বাংলা সম্মেলনের সফল হলে আদপে কতটা সফল হবে বাংলা ও বাঙালিরা? এই মুহূর্তে বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এই দুই সংগঠনের উপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
এ প্রসঙ্গে সদ্য প্রয়াত চিকিৎসক মুকুন্দ মজুমদারের কথাও উঠে আসে। তাঁর বাংলা ও বাংলা ভাষা বাঁচাও কমিটি কয়েক দশক আগে বাঙালিকে ভাষাগত জাতীয়তাবাদের পাঠ পড়িয়েছিল। কিন্তু সমাজমাধ্যম বা ডিজিটাল মিডিয়ার সুবিধা না পাওয়ায় সেই আন্দোলন ভালোভাবে নজরে আসেনি আম বাঙালির।