সিনেমায় ঋতুরঙ্গ – ঋতুপর্ণ ঘোষের সেরা কাজ
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: ১৯৯২ থেকে ২০১৩ – মাত্র ২১ বছরেই ঋতুপর্ণ ঘোষের মেধা এবং প্রতিভার ফসল দুর্দান্ত ১৯ টি ছবি। প্রত্যেকটি ছবিই স্বতন্ত্র,অনবদ্য। এর মধ্যে ১২টি ছবি জাতীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত। বাংলা সিনেমায় এক নতুন ধারা এনেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ।
সিনেমার মাধ্যমে তাঁর গল্প বলার ধরন ছুঁয়ে যেত প্রতিটি দর্শককে। শুধু চলচ্চিত্র পরিচালনার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিল না তাঁর প্রতিভা। দু’টি বহুল প্রচলিত বাংলা ম্যাগাজিনের সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। আরেকটি প্রেমের গল্প, মেমরিস ইন মার্চ ও চিত্রাঙ্গদা – এই তিন সিনেমায় অভিনেতা ঋতুপর্ণ ঘোষের অভিনয় প্রতিভার পরিচয় পেয়েছেন দর্শক।
আজ তাঁর দশম মৃত্যুবার্ষিকীতে চলুন দেখে নেওয়া যাক বাংলার এই প্রতিভাবান পরিচালকের কিছু অনবদ্য কাজঃ
হীরের আংটি (১৯৯২)
ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত প্রথম সিনেমা। অভিনয় করেছেন বসন্ত চৌধুরী, প্রদীপ মুখোপাধ্যায়, অয়ন মুখোপাধ্যায়, মুনমুন সেন, সুমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। একটি হীরের আংটি এবং তার দাবিদার এই সিনেমার মূল বিষয়বস্তু। যদিও দাবি করা হয় এটি ছোটদের ছবি, এই সিনেমার অন্তর্নিহিত বার্তা যথেষ্ট পরিণত ও যুগোপযুগী।
উনিশে এপ্রিল (১৯৯৪)
একাধিক জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত এই সিনেমায় পরিচালক তুলে ধরেছেন এক মা-মেয়ের জটিল সম্পর্কের রসায়ন। অভিনয় করেছেন অপর্ণা সেন, দেবশ্রী রায়, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়।
এই সিনেমার জন্যে শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে ঋতুপর্ণ ঘোষ এবং শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে দেবশ্রী রায় জাতীয় পুরস্কার পান।
দহন (১৯৯৭)
সুচিত্রা ভট্টাচার্য রচিত একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি এই ছবি। মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন ইন্দ্রাণী হালদার এবং ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ ও সমাজের দ্বিচারিতাই ছবির মূল উপাদান। চোখে আঙুল দিয়ে ঋতুপর্ণ আমাদের মুখোমুখি বসিয়েছেন রূঢ় বাস্তবের সাথে।
বাড়িওয়ালি (১৯৯৯)
ছবিটিতে অভিনয় করেছেন কিরণ খের, সুদীপ্তা চক্রবর্তী এবং চিরঞ্জিত চক্রবর্তী। এক মধ্যবয়সী মহিলার একাকিত্বের জীবনে নতুন আশার আলো নিয়ে আসে এক সিনেমা শুটিংয়ের দল। নতুন প্রভাতের স্বপ্ন দেখিয়েও মোহভঙ্গ করে তারা অমার নিশিতে তাঁকে একা রেখেই চলে যায়। জীবন চলতে থাকে নিজস্ব গতিতে। এই ছবির জন্য সেরা অভিনেত্রী ও সেরা সহ অভিনেত্রীর পুরস্কার পান কিরণ ও সুদীপ্তা।
উৎসব (২০০০)
বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপুজো। কিন্তু উৎসবের প্রদীপের তলার যে অন্ধকার, সেটা কতজন খেয়াল করে থাকি আমরা? এই সিনেমাটি মধ্যবিত্ত পরিবারের বিভিন্ন সাধারণ ও জটিল সমস্যা নিয়ে তৈরি। দুর্গাপুজো উপলক্ষে এক পরিবারের সকলে একত্রিত হয়েছেন গ্রামের বাড়িতে। আর তার পরেই শুরু হয় সম্পর্কের টানাপোড়েন।
এই সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পান ঋতুপর্ণ। ছবিটিতে অভিনয় করেছেন মাধবী মুখোপাধ্যায়, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, মমতা শঙ্কর, অর্পিতা পাল প্রমুখ।
শুভ মহরৎ (২০০৩)
আগাথা ক্রিস্টির স্বনামধন্য গোয়েন্দা চরিত্র মিস মারপেল এর গল্প ‘দ্য মিরর ক্র্যাকড ফ্রম সাইড টু সাইড’ অবলম্বনে তৈরি ছবি। মিস মারপেল এখানে আদ্যোপান্ত বাঙালি ঘরোয়া এক মহিলা। রাঙাপিসিমা। ঘরে বসে গল্পোচ্ছলে একটি খুনের রহস্য সমাধান করেন তিনি। কিন্তু এটা শুধুই খুনের রহস্যের গল্প নয়। মনস্তত্বের গভীরে বিচরণ করেছেন পরিচালক, যা এই ছবিকে উৎকর্ষের শিখরে নিয়ে গেছে।
চোখের বালি (২০০৩)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাহিনী অবলম্বনে তৈরি এই সিনেমা। অভিনয় করেছেন ঐশ্বর্য রাই, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, রাইমা সেন এবং টোটা রায়চৌধুরি। শ্রেষ্ঠ বাংলা সিনেমা বিভাগে এই ছবি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। রবি ঠাকুরের গল্পে স্বকীয়তার ছাপ রেখেছেন পরিচালক। সমাজে নারীর স্থান নিয়ে বিদ্রোহের বসন্ত নির্ঘোষ শোনা গেছে বিনোদিনীর মুখে।
রেনকোট (২০০৪)
হিন্দি ভাষায় তৈরি ঋতুপর্ণ ঘোষের এই ছবি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের জন্যে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। ছবিটিতে অভিনয় করেছেন অজয় দেবগণ এবং ঐশ্বর্য রাই। ও’হেনরির ‘গিফট অফ দ্য ম্যাজাই’ অবলম্বনে তৈরি এই ছবিতে নিঃস্বার্থ প্রেমের ছকভাঙা গল্প বলেছেন পরিচালক।
দোসর (২০০৬)
কালার এবং ডিজিটালের যুগে সাদা কালোয় ছবি বানিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। উপরন্তু, ছবিতে সীমিত আবহ সঙ্গীতের ব্যবহার তাক লাগিয়েছিল দর্শকদের মনে। পরকীয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে সমাজে এক নতুন বিতর্ক শুরু করেছিলেন পরিচালক। উপরি পাওনা, কঙ্কনা ও প্রসেনজিতের অসামান্য রসায়ন
চিত্রাঙ্গদা (২০১২)
ঋতুপর্ণ ঘোষের শেষ সিনেমা। এই সিনেমায় পরিচালক প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষদের গল্প বলেছেন। অনেকেই মনে করে থাকেন এটি তাঁর আত্মজীবনীমূলক। মূল চরিত্রে অভিনয় করেন স্বয়ং ঋতুপর্ণ। এছাড়াও এই ছবিতে অভিনয় করেছেন যীশু সেনগুপ্ত, রাইমা সেন, অঞ্জন দত্ত, দীপঙ্কর দে।
যে সমাজে যৌনতা সম্পর্কে এখনও খোলাখুলি কথা বলা যায় না, সেখানে লিঙ্গ-চেতনার এই অভূতপূর্ব কাজ অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছে বাংলা সিনেমাকে।
আবহমান (২০১০)
ঋতুপর্ণর অন্যতম সেরা কাজ। একাধারে বাবা-ছেলের সম্পর্কের কথা বলে। অন্যদিকে শিল্পী ও তাঁর প্রেরণার পরম্পরা। সফিস্টিকেশন বনাম আন-সফিস্টিকেটেড এর তরজা। ঋতুপর্ণর দর্পণে নটি বিনোদিনীর এক অন্য আঙ্গিক ধরা পড়েছে। অনেকে অবশ্য এই ছবিতে সত্যজিৎ মাধবীর কেচ্ছাও খুঁজেছেন।