‘পদ্মভূষণ’ সম্মান পেলেন উস্তাদ রসিদ খান
এক সত্যিকারের সুসংবাদ এসে পৌঁছেছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতে। উস্তাদ রাশিদ খান ‘পদ্মভূষণ’ সম্মান লাভ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের পক্ষেও এ এক বড় সম্মান, কেননা উস্তাদ রাশিদ খান কলকাতায় বাস করেন এবং তিনি বাংলার আপনজন।
উস্তাদ রাশিদ খানের গান আশির দশক থেকে শুনে আসছি। তাঁকে আমি পরিবারের সদস্য বলেই মনে করি। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উস্তাদ রাশিদ খানকে আগেই সঙ্গীত মহাসম্মান ও বঙ্গবিভূষণে ভূষিত করেছেন। সেই সব অনুষ্ঠানে দু’-এক মিনিটের সৌজন্য সাক্ষাতের সূত্রে তাঁকে পরিবারের সদস্য হিসেবে দাবি করছি না। তাঁর গান আমরা তিন জনে, অর্থাৎ আমি, কাবেরী ও বুকুন, একসঙ্গে শুনে থাকি প্রায়ই। আমাদের ঘরে তাঁর গান পৌঁছনো মানেই তিনি ঘরের লোক হয়ে উঠেছেন।
উস্তাদ রাশিদ খান তাঁর দাদু উস্তাদ নিসার হুসেন খানের কাছে প্রাথমিক তালিম পেয়েছিলেন এ কথা সকলেই জানি। তবে রাশিদ খানের গাওয়া ছায়ানট রাগের ‘ঝনক ঝনক ঝন নন নন নন বাজে বিছুয়া’ বন্দিশটি যাঁরাই শুনেছেন তাঁরা জানেন, রাগটি তিনি অবিকল উস্তাদ নিসার হুসেন খানের ধরনে পরিবেশন করেননি। উস্তাদ নিসার হুসেনের গাওয়া এই বন্দিশটি দ্রুত্ তিন তালে নিবদ্ধ। অন্য দিকে উস্তাদ রাশিদ খান বন্দিশটি গেয়েছেন মধ্য লয়ে— অনেক ধীরে চলেছেন তিনি। গানের প্রথম শব্দ ‘ঝনক’ কথাটিতে মধ্য সপ্তকের আরম্ভের সা থেকে মন্দ সপ্তকের পঞ্চম পর্যন্ত নেমে গিয়ে আবার উঠতে থাকে বন্দিশটি। এই অংশে রাশিদ খানের কণ্ঠের গম্ভীর মন্দ্রতা যেন এই বন্দিশটির সূচনায় এক সতেজ সুরদীপ্তি দেয়। আবার মালবিকা কাননের গাওয়া ছায়ানট-এর একই বন্দিশ যাঁরা শুনেছেন, তাঁরা বুঝবেন বড় বড় শাস্ত্রীয় শিল্পীর গান শুনতে শুনতে রাশিদ খান তৈরি করেছেন তাঁর নিজস্ব এক গায়কী। তাঁর মারওয়া রাগে গাওয়া ক্যাসেটটির বিলম্বিত অংশে উস্তাদ আমির খানকে মনে পড়েছিল বটে— কিন্তু সে-ক্যাসেট বেরিয়েছিল তিরিশ বছরেরও বেশি আগে। পরে আর ওই বিলম্বিত বিস্তারের ধরন রাশিদ খানের গানে প্রবেশ করতে পারেনি।
তাঁর আরও দু’টি বড় গুণবাচক দিক নিশ্চয়ই শ্রোতাদের কানে ধরা পড়েছে— তা হল একই রাগ, তিনি দু’বার ঠিক একই রকম ভাবে পরিবেশন করেন না, রাগটিকে প্রতিবার নতুন রাস্তায় এগিয়ে নেওয়ার দিকে তাঁর সুরকল্পনা কাজ করে। শ্যামকল্যাণ রাগে তাঁর যে সিডি পাওয়া যায়, সেখানে আরম্ভে, আওচারের সময়ে তীব্র মধ্যমটি লাগান একটু দেরি করে। শ্রোতাদের আকুলতা বাড়িয়ে তবে পৌঁছন কড়িমা পর্দাটিতে। আবার কলামন্দিরে একবার শ্যামকল্যাণ রাগে তীব্র মধ্যমে আসতে এতই সময় নিলেন তিনি যে শ্রোতারা ব্যাকুল উঠলেন। উস্তাদ শাহিদ পারভেজের সেতারের সঙ্গে তাঁর যুগলবন্দির রেকর্ডটি চিরস্মরণীয় হয়ে আছে— রাগ বাগেশ্রীর রূপায়ণে দু’জনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না— বরং ছিল রাগটির রূপমাধুর্যকে খুলে ধরা, ছিল নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ সুরের রাস্তা ধরে ধরে এগোনো।
শরৎ সদনে এক বার গৌড় সারং শুনেছিলাম। রাগের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বেহাগের জায়গাটি কেমন ভাবে এসে চলে যায়, তা হঠাৎ চমকের মতো এলেই ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন উস্তাদ রাশিদ খান। অত্যন্ত সংযম ও পরিমিতি বোধের পরিচয় ছিল সেখানে। গৌড় সারংকে কেন ‘দিন কা বেহাগ’ বলা হয়, শ্রোতারা অনুভব করেছিলেন সে দিন।
উস্তাদ রাশিদ খানের কাছে আমি বিশেষ কৃতজ্ঞ অন্য একটি কারণে। আমি অন্তত দু’বার তাঁর গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনেছি। প্রথম বার শুনেছিলাম গ্র্যান্ড হোটেলে আনন্দ পুরস্কার প্রদানের অনুষ্ঠানে। প্রথমে একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কারণ তিনি শ্রী রাগের আওচার ধরেছিলেন, একেবারে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধরনে। আমার আতঙ্ক জন্মাচ্ছিল, হয়তো রবীন্দ্রনাথের বাণীর উপর উক্ত রাগটির নানাবিধ সুরকৌশল ও অলঙ্করণ প্রয়োগ করবেন তিনি। রবীন্দ্রগানে বাণীর যে-শুদ্ধতা, তা বুঝি বা ছিঁড়েখুঁড়ে যাবে। রবীন্দ্রনাথ তো তাঁর গানকে বাহুল্যমুক্ত করতেই চেয়েছিলেন। অথচ আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, যখন গানের বাণীতে প্রবেশ করলেন, কোথাও একটিও অতিরিক্ত স্বর প্রয়োগ করলেন না। একাগ্র মনে গেয়ে চললেন ‘কার মিলন চাও বিরহী’, শ্রী রাগের আত্মা প্রতিষ্ঠিত হল যেন সংযমী গায়নে। দ্বিতীয় গানটি ছিল ‘কে বসিলে আজি হৃদয়াসনে ভুবনেশ্বর প্রভু’। সিন্ধুরাগে আশ্রিত এই গানের শুরুতে আবারও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধরনেই আওচার রাখলেন। কিন্তু গানের বাণীর মধ্যে অতিরিক্ত অলঙ্করণ এল না। প্রথম লাইনের শেষ শব্দ ‘প্রভু’ যখন এল, তখন শুদ্ধ রে থেকে পঞ্চমে গিয়ে তিনি দাঁড়ালেন একটুক্ষণ, আর প্রেক্ষাগৃহ ভরে গেল গভীর সুরের আচ্ছাদনে।
মাতৃভাষা বাংলা না-হলেও, বাংলার বিশ্বকবির গান উস্তাদ রাশিদ খান যে-বিহিত শ্রদ্ধা নিয়ে নিবেদন করলেন, তা তাঁর প্রতি আরও শ্রদ্ধাবান করে তুলল আমাকে। এই শ্রদ্ধা বাংলার ঘরে ঘরে তাঁর শ্রোতাদের মনে সঞ্চিত আছে। আজ যে সম্মান তিনি লাভ করলেন, তার দ্বারা উস্তাদ রাশিদ খানের প্রতি আমাদের মতো সাধারণ শ্রোতার ভালবাসাই জয়যুক্ত হল। জয়যুক্ত হল বাংলা।