ভিন্ন ধারার ‘কাশ্মীর ফাইল’ – আজও মিলেমিশে রয়েছেন কাশ্মীরি পণ্ডিত ও মুসলিমরা

কাশ্মীরে অচলাবস্থা শুরু হওয়ার পরও নিজের জন্মভূমি ছেড়ে যাননি ৬৫ বছরের চুনিলাল

April 9, 2022 | 3 min read
Published by: Drishti Bhongi
প্রতিকী ছবি। ছবি সৌজন্যেঃ রয়টার্স

দ্য কাশ্মীর ফাইলস ছবিটি সদ্য মুক্তি পেয়েছে। তা নিয়ে ইতিমধ্যেই দেশজুড়ে হইচই চলছে। কিন্তু ছবিটি যে শহরের, সেই শ্রীনগরের সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া কী? সেখানে কেমন আছেন কাশ্মীরি পণ্ডিতরা?

কাশ্মীরে অচলাবস্থা শুরু হওয়ার পরও নিজের জন্মভূমি ছেড়ে যাননি ৬৫ বছরের চুনিলাল। তিনি একজন কাশ্মীরি পণ্ডিত, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী। ২৫ বছর ধরে জম্মু ও কাশ্মীর স্টেট ইনডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের নেতা তিনি। তিনি আবার হিন্দু ওয়েলফেয়ার সোসাইটি কাশ্মীরেরও প্রেসিডেন্ট। শ্রীনগরের হাব্বা কাদাল এলাকায় স্ত্রী, ছেলেকে নিয়ে থাকেন তিনি। তাঁর আশেপাশে সব মুসলিম পরিবার। চুনিলাল বলেন তিনি মুসলিম ভাইদের জন্যই কাশ্মীর ছেড়ে যাননি। তিনিই জানান, ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য তাঁকে কখনও কোনও সমস্যার মুখে পড়তে হয়নি। এত বছরের মধ্যে কেউ কখনও হুমকিও তাঁকে দেয়নি।

তিনি নিজেই জানিয়েছেন, অন্য সবার মতো স্বাধীনভাবে যেখানে খুশি যাতায়াত করতে পারেন তিনি। চুনিলালের ২৫ বছরের ছেলের জন্ম, বেড়ে ওঠা সবই শ্রীনগরে। চুনিলালের ছেলে এখন শ্রীনগরেই একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। সেই অভিশপ্ত দিন নিয়ে সাম্প্রদায়িক রঙ লাগিয়ে কেউ কেউ পরিস্থিতি খারাপ করতে চাইছে বলে অভিযোগ করেন চুনিলাল।

চুনিলালের মতো আরও ৮০৮টি কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিবার সেই দুর্দিনেও উপত্যকা ছেড়ে যাননি। আজ কাশ্মীরে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গেই তাঁরা বসবাস করছেন। চুনিলাল কাশ্মীর ফাইলস সিনেমা সম্পর্কে বলছিলেন, ‘কাশ্মীরি পণ্ডিতদের কষ্ট, দুর্দশা নিয়ে সিনেমাটা হয়েছে শুনলাম। তবে যেসব কাশ্মীরি পণ্ডিত সেসময় উপত্যকা ছেড়ে যাননি, তাঁরা কী অবস্থায় ছিলেন, সরকার কীভাবে তাঁদের বঞ্চিত করেছে, সেসবও সিনেমায় তুলে ধরা উচিত ছিল।’

কাশ্মীর ফাইলসের দরাজ প্রশংসা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। কিন্তু কাশ্মীর ও সারা ভারতের মুসলিমরা এই চলচ্চিত্রের সমালোচনায় সরব হয়েছেন। তাঁদের মতে, সিনেমায় শুধুমাত্র অর্ধেক সত্য পরিবেশন করা হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয়, ঘৃণা জাগিয়ে তোলার চেষ্টাও করা হয়েছে। কীভাবে সিনেমা চলাকালীন হলের মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষী স্লোগান তোলা হয়েছে, তার কিছু নামুনা ভাইরাল ভিডিওতে দেখা গিয়েছে।

চুনিলালের কথায়, কাশ্মীরের মতো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অন্য কোথাও দেখা যায় না। মুসলিম, হিন্দু, শিখ সম্প্রদায়ের মানুষের এক সংস্কৃতি। সবাই এখানে একে অপরের উৎসবে অংশ নেন। তিনি বলেন, হিন্দুর আমার তাঁর মুসলিম বন্ধুর সংখ্যা বেশি। ঈদে তাঁর বন্ধুরা তাঁকে নিমন্ত্রণ জানায়। শিবরাত্রির শুভেচ্ছা জানান, জানিয়েছিল চুনিলাল। অত্যাচারের ঘটনার জন্য শুধু মুসলিমদের দোষ দিতে নারাজ চুনিলাল। তাঁর মতে, ‘হিন্দুদের মতো বহু মুসলিমও অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন।’ কিন্তু হিন্দুরা কাশ্মীরে সংখ্যালঘু বলে তাঁদের উপর ভয়টা বেশি ছিল।

আরেক কাশ্মীরি পণ্ডিত উমেশ তালাশি জানিয়েছেন,’ কাশ্মীরি হিন্দুদের দুর্দশার কথা নিয়ে বিজেপি ভোটব্যাংক বাড়িয়েছে। এখন বলিউডও একইভাবে টাকা কামাচ্ছে। কিন্তু দুর্দশা একই রয়ে গিয়েছে। মনে রাখবেন, ভালোবাসার মাধ্যমেই শান্তি ফেরানো সম্ভব। ঘৃণা সব কাশ্মীরিকে ছিন্নভিন্ন করে দেবে।’

উমেশ স্মৃতিতে উঠে আসে, কীভাবে একটা সময় তাঁর বাবাকে কাশ্মীর ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য হুমকি দিত উগ্রপন্থীরা। কিন্তু প্রতিবারেই স্থানীয় মুসলিমরা তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান। একটা সময় দিনের পর দিন মুসলিম প্রতিবেশীর বাড়িতে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল তাঁকে। পরে অবস্থা বুঝে উমেশের বাবাকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যান প্রতিবেশীরা। তাঁদের সঙ্গে যা হয়েছে তা দুর্ভাগ্যজনক। এটা কোনভাবেই তাঁদের প্রাপ্য ছিল না। কিন্তু তাও উমেশ জানান, তাঁদের সঙ্গে যা হয়েছে, তার জন্য সব কাশ্মীরি মুসলিমকে তাঁরা দায়ী করতে পারি না।

চুনিলাল বা উমেশের মতো কাশ্মীর ছাড়েননি সানি কাউলও। তাঁর দুই সন্তান এখন ভিনরাজ্যে কর্মরত। স্ত্রীকে নিয়ে কাশ্মীরে নিশ্চিন্তেই রয়েছেন তিনি। সানি বলেন, “২০২০ সালে আমার এক আত্মীয় মারা যান। সেসময় তাঁর শেষকৃত্যে মুসলিম প্রতিবেশীরা সাহায্য করেছিলেন। আমার যখন করোনা হয়, তখন মুসলিম বন্ধুরা গাড়ি করে আমায় হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল।”

অভিবাসীদের প্রত্যাবর্তন, পুনর্মিলন ও পুনর্বাসন কমিটির চেয়ারম্যান সতীশ মহলদারের মতে, ‘বিবেক অগ্নিহোত্রীর সিনেমাটি বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত। সেই সময় ভিপি সিংয়ের নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে বিজেপির সমর্থন ছিল। সিনেমায় সেটা দেখানো হয়নি। মাসুদ আজহার ও মুস্তাক লাটরামকে জেল থেকে ছাড়ল, সেটাও কোথাও উল্লেখ নেই। সেই সময় কাশ্মীরি শিখ ও মুসলিমদেরও যে হত্যা করা হল, সিনেমায় সেটাও দেখানো হয়নি। কাশ্মীরের গণহত্যার জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ব্যর্থতা দায়ী। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সেসময় উপত্যকা ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হল। বলা হল জম্মুতে তাঁদের বিনামূল্যে রেশন দেওয়া হবে। কিন্তু আদপে কোনও ব্যবস্থা ছিল না।’

কাশ্মীরি পণ্ডিতদের হত্যার পাশাপাশি চিত্তিসিংপুরা, কুনান পোশপোরা ও গওকাদালের ঘটনারও বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছেন তিনি। তিনি আরও বলেন, “আমি নিজে একজন কাশ্মীরি পণ্ডিত। নয়াদিল্লিতে থাকি। সরকারের কাছে আমার একটাই প্রশ্ন, আমি আমার জন্মভমিতে কবে ফিরব?”

কাশ্মীরি পণ্ডিত সংগরিশ সমিতির নেতা সঞ্জয় টিকু সম্প্রতি একটি টুইটে লিখেছেন, “সব কাশ্মীরি মুসলিম সন্ত্রাসবাদী নয়। সব কাশ্মীরি পণ্ডিত সাম্প্রদায়িক নয়। আমরা সবাই একে অপরকে ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি। গত তিন দশক ধরে কাশ্মীরিরা যেভাবে কষ্ট ভোগ করেছেন, আমরা সেই কষ্ট একে অপরের সঙ্গে ভাগ করি। দ্য কাশ্মীর ফাইলস উপত্যকায় বসবাসকারী কাশ্মীরি পণ্ডিতদের অসুরক্ষিত বানিয়ে দিয়েছে।” টিকু নিজে কাশ্মীর ছেড়ে কখনও যাননি। তাঁর সংগঠন আজও কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সমানাধিকারের জন্য লড়াই করছে।

কাশ্মীরের রাজনৈতিক নেতারা কাশ্মীর ফাইলসের সমালোচনায় মুখর। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা বলেন, ‘সেই সময় জম্মু ও কাশ্মীরে রাজ্যপালের শাসন ছিল। আমার দল ক্ষমতায় ছিলই না। কেন্দ্রে বিজেপি সমর্থিত ভিপি সিংয়ের সরকার ছিল। তখন যে শুধু কাশ্মীরি পণ্ডিতরা উপত্যকা ছেড়েছিলেন তা নয়। বহু শিখ ও মুসলিমও উপত্যকা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।’

প্রধানমন্ত্রীর এই ছবি প্রচার করার বিরুদ্ধে সমালোচনায় সরব হয়েছে, কাশ্মীরের আরেক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী পিডিপির মেহবুবা মুফতি। তাঁর মতে, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের দুর্দশাকে হাতিয়ার করে যা করা হচ্ছে, তাতে কেন্দ্রের অসৎ মানসিকতা প্রকাশ পাচ্ছে।

অথচ এসবের মধ্যেও শ্রীনগরের কাশ্মীরি পণ্ডিতরা কিন্তু একেবারেই স্বাভাবিক। দেশজুড়ে চলচ্চিত্রকে ঘিরে উত্তেজনার বিন্দুমাত্র রেশ কিন্তু তাঁদের গায়ে লাগেনি। শ্রীনগরে বিভিন্ন মহল্লায় মিলেমিশেই রয়েছেন কাশ্মীরি পণ্ডিত ও মুসলিমরা। যা সম্প্রীতির ভারতের সাক্ষ্য বহন করে।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

ভিডিও

আরও পড়ুন

Decorative Ring
Maa Ashchen