পাঁচশো বছরের প্রাচীন গোপীনাথকে ঘিরে চলে আসছে অগ্রদ্বীপের মেলা
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: কাটোয়ার কাছেই অগ্রদ্বীপ গ্রাম। গ্রামটি বৈষ্ণব-তীর্থক্ষেত্র, এখানেই রয়েছে পাঁচশো বছরের পুরনো গোপীনাথ মন্দির। মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে কষ্টিপাথরের গোপীনাথ, অষ্টধাতুর রাধিকা মূর্তি। প্রতি বছর চৈত্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথিতে এখানে মেলা বসে। মেলাটি অগ্রদ্বীপের গোপীনাথের মেলা নামে পরিচিত। সাধক গোবিন্দ ঘোষ ও তাঁর আরাধ্য গোপীনাথকে কেন্দ্র করেই এই মেলা। প্রতি বছর দশ থেকে বারো লক্ষ মানুষ এই মেলায় আসেন। পুণ্যার্থীদের জন্য চারশো থেকে পাঁচশো আখড়া তৈরি হয়। মেলার বয়স কম পক্ষে পাঁচশো বছর হবেই। জনশ্রুতি অনুযায়ী, ১৫১৫ সালের ফাল্গুন মাসে গোবিন্দ ঘোষের কাছে এসে ছিলেন শ্রীচৈতন্য। শ্রীচৈতন্য একটি কৃষ্ণ বিগ্রহ তৈরি করিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন এখানে। চৈতন্যই কৃষ্ণের নাম দেন গোপীনাথ। গোপীনাথের সেবার দায়িত্ব গোবিন্দ ঘোষকে দিয়ে নীলাচলে চলে যান শ্রীচৈতন্য।
কিংবদন্তি অনুযায়ী, ১৫৮৮ সালে চৈত্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথিতে মারা হয়েছিলেন শ্রীচৈতন্যের একনিষ্ঠ ভক্ত গোবিন্দ ঘোষ। এই গোবিন্দ ঘোষ ছিলেন শ্রীচৈতন্যর অষ্ট পার্ষদের অন্যতম একজন। তিনি ছিলেন গোপীনাথের সেবক। সেই তিথিকে স্মরণে রাখতেই প্রতি বছর গোবিন্দ ঘোষের পারলৌকিক হিসেবে চিড়ে মহোৎসব আয়োজিত হয়। স্বয়ং গোপীনাথ এক মাস ধরে হবিষ্যান্ন গ্রহণ করেন। শ্রাদ্ধের কাছা ধারণ করেন। গোবিন্দ ঘোষের পারলৌকিক ক্রিয়ায় পিণ্ডদানের জন্যই এই আয়োজন। জনশ্রুতি রয়েছে, শিশুপুত্রর মৃত্যুর পর শোকে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন গোবিন্দ ঘোষ। তখন গোপীনাথ তাঁকে স্বপ্নে দেখা দেন। তিনিই পুত্র হিসেবে গোবিন্দ ঘোষের শ্রাদ্ধ করবেন বলে তাঁকে আশ্বাস দেন। সেই কথা মেনে গোবিন্দ ঘোষের মৃত্যুর পরে তাঁর শ্রাদ্ধ করেন গোপীনাথ। অনেকে বলেন, একমাত্র এখানেই নাকি ভগবান ভক্তের শ্রাদ্ধ করেন। সেই প্রথা আজও চলছে।
অগ্রদ্বীপের খ্যাতি বারুণীর স্নান উৎসবের জন্যই। চৈত্র মাসে কৃষ্ণ পক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে এই স্নান হয়। জনশ্রুতি রয়েছে, শ্রীচৈতন্যর আবির্ভাবের অনেক আগেই এই উৎসব চলে আসছে। বাংলা, বিহার, ওড়িশা এবং ওপার বাংলার নানা প্রান্ত থেকে মানুষ অগ্রদ্বীপে বারুণীর স্নানে সামিল হতে আসতেন। আঠারো উনিশ শতকে গঙ্গাসাগর মেলার চেয়েও অগ্রদ্বীপের বারুণীর স্নানের খ্যাতি বেশি ছিল। এখানেও গঙ্গাবক্ষে সন্তান বিসর্জন দেওয়ার রীতি ছিল।
গোপীনাথ বিগ্রহ ও গোবিন্দ ঘোষকে ঘিরে রয়েছে পাঁচ শতকের কিংবদন্তি। মহাপ্রভু শ্রীক্ষেত্র যাওয়ার সময়, যে ক’জন তাঁর সঙ্গ নেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন গোবিন্দ ঘোষ। অগ্রদ্বীপের আগের কোনও এক গ্রামে মহাপ্রভু দুপুরবেলা মুখশুদ্ধি হিসাবে একটু হরীতকী চেয়েছিলেন চৈতন্য। গোবিন্দ তা জোগাড় করে দেন। যাত্রা পথে তিনি যদি আবার চান, তাই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এক টুকরো নিজের কাছেও রাখেন। পরদিন দুপুরে গোবিন্দ ঘোষ প্রভুর দিকে এক টুকরো হরীতকী এগিয়ে দিতেই প্রভু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন এ হরীতকী তিনি কোথায় পেলেন? গোবিন্দ বলেন, তাঁর সেবায় যদি লাগে, তাই তিনি রেখে দিয়েছিলেন। এই ঘটনায় খুশি হওয়ার বদলে রুষ্ট হয়ে শ্রীচৈতন্যদেব গোবিন্দকে সেখানেই থেকে যেতে আদেশ করেন। কারণ গোবিন্দ সঞ্চয় বাসনা মুক্ত নয়। সন্ন্যাসীর সঞ্চয়ের বাসনা থাকা উচিত নয়। গোবিন্দ ঘোষ বলেন, তিনি যদি সঞ্চয় করে থাকেন, তা নিজের জন্য নয়, অপরের জন্য। চৈতন্যদেবের উত্তর ছিল যার জন্যই সঞ্চয় করা হোক, তা একধরনের স্বার্থের কথা, বৈরাগ্য হয় না। তাই তিনি বলেন, সেখানে থেকে, বিয়ে করে গৃহী হয়ে যেতে।
গোবিন্দ ঘোষ রয়ে গেলেন অগ্রদ্বীপেই। একদিন গঙ্গাস্নানের সময় তার পায়ে কালো রঙের কিছু একটা জিনিস ঠেকল। সঙ্গে সঙ্গে দৈববাণী হল, ওটা নারায়ণ শিলা, এই শিলা দিয়ে বিগ্রহ বানিয়ে বাৎসল্যভাবে পুজো করো। দাঁইহাটের এক শিল্পী এসে গড়ে দিলেন গোপীনাথের মূর্তি। মূর্তির চোখদুটিতে শ্বেতশঙ্খ বসানো। গোপীনাথ বিগ্রহ ও গোবিন্দ ঘোষের সম্পর্ক ছিল পিতা-পুত্রের। গোবিন্দ ঘোষের স্ত্রী আগেই পরলোকগত হয়েছিলেন। একমাত্র পুত্রর মৃত্যুর পর গোপীনাথ গোবিন্দ ঘোষকে মনস্তাপ করতে নিষেধ করেন। স্বয়ং গোপীনাথ নাকি বলেছিলেন ঘোষঠাকুরের মৃত্যুর পর তাঁর শ্রাদ্ধাদিকার্য গোপীনাথের দ্বারাই সম্পন্ন হবে।
একদা বারুণী উৎসবের আগে চৈত্র মাসের একাদশী তিথিতে গোবিন্দ ইহলোক ত্যাগ করেন। জনশ্রুতি রয়েছে, সেদিন গোপীনাথের চোখ থেকে বিন্দু বিন্দু অশ্রুকণা ঝরতে দেখা দিয়েছিল। তাঁকে দাহ না করে মন্দিরের পাশে সমাধিস্থ করা হয়। শোনা যায়, দ্বাদশ দিবসে স্বয়ং গোপীনাথ শ্রাদ্ধের বস্ত্র ও কুশাঙ্গুরীয় পরিধান করে পুত্ররূপে ঘোষঠাকুরের শ্রাদ্ধকার্য সম্পাদন করেন। আজও প্রতি বছর ওই তিথিতে বিগ্রহকে শ্রাদ্ধের বসন পরানো হয় এবং পুরহিতরা মন্দিরের মেঝেয় কুশ বিছিয়ে বিগ্রহের হাতে পিণ্ড তুলে দিয়ে দরজা বন্ধ করে বাইরে আসেন। কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলে নাকি দেখা যায়, কুশের ওপর পিণ্ড পড়ে আছে।
এখনও গোপীনাথকে কাছা পরিয়ে কেশহীন অবস্থায় গোবিন্দ ঘোষের সমাধিমন্দিরে নিয়ে এসে কুশ ও পিণ্ড তাঁর হাতে রাখা হয়। শ্রাদ্ধের কাজ শেষ হলে মন্দিরে ফিরিয়ে এনে রাজবেশ পরানো হয়। উৎসব কয়েকদিন ধরে চলে। প্রথম দিনে কেউ অন্নগ্রহণ করে না। দই-চিঁড়ে-কলা খেয়ে চিঁড়ে মহোৎসব পালন করে। দ্বিতীয় দিনে অন্ন মহোৎসব, তৃতীয় দিনে বারুণী স্নান, চতুর্থ দিনে দোল উৎসব হয়। আগে বারো দোলের সময় গোপীনাথকে কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে নিয়ে যাওয়া হত।