বাংলার দুগ্গা পুজো: জেনে নিন শতাব্দী প্রাচীন গঙ্গাপাড়ের হালদার বাড়ির পুজোর ইতিহাস
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: প্রায় ৪৫০ বছর প্রাচীন চুঁচুড়া হালদার বাড়ির দুর্গাপুজো। কথিত আছে, গঙ্গার পারে অবস্থিত হালদার বাড়ির পূর্ব দিকে ছিল বেতের জঙ্গল ও শ্মশান। সেই শ্মশানের পাশেই বাস করতেন এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ। নানা সময় বিপদে পড়লে অনেকেই আশ্রয় নিতেন ওই ব্রাহ্মণের কুটিরে। কোনও এক দুর্যোগের রাতে সেই কুটিরে আসেন এক বৃহন্নলা। দরিদ্র ব্রাহ্মণ আশ্রয় দেন সেই বৃহন্নলাকে। ভোর রাতে ঘুম থেকে উঠে ব্রাহ্মণ দেখেন সেই বৃহন্নলা নেই। ঘরে রাখা রয়েছে এক ঘড়া মোহর। সেই এক কলসি মোহর ফেরত দিতে সেই বৃহন্নলার খোঁজ শুরু করেন। কিন্তু তাঁর খোঁজ পাওয়া যায় না। খুঁজে না পেয়ে ব্রাহ্মণ ক্লান্ত অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েন। তখনই স্বপ্নে মা দুর্গার আবির্ভাব হয়। নির্দেশ দেন পুজো শুরু করার। তারপর থেকেই সূচনা হয় এই পুজোর।
রথ যাত্রার দিন কাঠামো পুজো হয়। কৃষ্ণনগর থেকে কুমোর আসেন। মায়ের বিগ্রহ তৈরির কাজ শুরু হয়। মহালয়ার পরেরদিন থেকে কুলদেবতা বাসুদেব শ্রীধরের ঘরে মা চণ্ডীর ঘট বসিয়ে পুজো শুরু হয়। দুর্গার ভোগ রান্নার জন্য ওড়িশা থেকে রাঁধুনি নিয়ে আসা হয়। প্রত্যেক দিন পাঁচ রকম ভাজা হয়। থোড়, ছাঁচি কুমড়ো, কচু, নানচে পাতা ও বাড়িতে তৈরি বিউলির ডালের বড়ি দিয়ে শুক্তো হয়। কাঁচা তেতুল ও খেশারির ডালের তৈরি বড়ির টক, তরকারি ও পায়েস করেন রান্নার ঠাকুর। ষষ্ঠীর দিন ঠাকুর দালানের পাশে রাখা হয় বোধনের ঘট। সুসজ্জিত দুর্গাকে দালানে বরণ করা হয়। ঠাকুর ঘর থেকে কূল দেবতাদের আনা হয় দালানে।
পরিবারের সদস্যদের বিশ্বাস মা দুর্গা মাথার ঘোমটা টেনে সিঁড়ি দিয়ে নেমে পথে হাঁটতে বের হন। তাঁকে কতবেল মেখে দেওয়া হয়। আর পুজোর চারদিন থাকে বিপুল আয়োজন। কাঁচা তেতুল আর খেসারির ডাল। বড়ি দিয়ে বানানো টক, শুক্তো ইত্যাদি। এই দিয়ে প্রতিদিন খাওয়াদাওয়া সারেন চুঁচুড়ার হালদার বাড়ির দুর্গা। কখনও দেওয়া হয়, পোলাও, পনিরের তরকারি। দশমীতে বিসর্জনের পর মধ্যরাতে মাছ খান পরিবারের সদস্যরা। তারপর ধুতি-পাঞ্জাবি পরে অপরাজিতা ফুলের বালা হাতে জড়িয়ে পাড়ায় হাঁটতে বের হন পরিবারের পুরুষ সদস্যরা।
এই বাড়ির পুজো হয় বৈষ্ণব মতে। চালকুমড়ো বলি হয়। অষ্টমী পুজোয় ধুনো পোড়ানোর রীতি আজও চলছে। নবমী তিথিতে কোনও এক ব্রাহ্মণ কুমারীকে মাতৃরূপে পুজো করা হয়। সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত হোমকুণ্ড জ্বালানো হয়। দশমীতে বাড়িতে অরন্ধন পালিত হয়। বিসর্জনের পর রাতে রান্না হয়। রীতি অনুযায়ী অপারাজিতা গাছ কেটে শুকিয়ে সাদা মার্কিন কাপড় হলুদ জলে শুকিয়ে তা দিয়ে বালা তৈরি হয়। দশমীর সকালে ওই বালা মায়ের হাতে ও কুলদেবতাদের পরানো হয়। বাড়ির সকল সদস্য ধুতি, পাঞ্জাবি পরে ওই বালা ধারণ করে। দশমীর দিন হালদারদের সঙ্গে অপরাজিতা ধারণ করে ষন্ডেস্বর মন্দিরে পুজো দেন। রীতি ও ঐতিহ্য মেনে বাড়ির ছেলেরাই পুজোর দিন ঢাক বাজায়।