পুজো স্পেশাল বিভাগে ফিরে যান

পৌষ মাসে ‘তোষলা’ ব্রতে কী স্তুতিগান করে থাকেন বাংলার মা-মেয়েরা?

December 29, 2023 | 2 min read

পৌষ মাসে ‘তোষলা’ ব্রতে কী স্তুতিগান করে থাকেন বাংলার মা-মেয়েরা?

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: গ্রাম বাংলায় লোকাচার হিসেবে যে ব্রতগুলি ছোটো এবং অপ্রধান, সেগুলো শাস্ত্রের হাত থেকে বেঁচে গিয়ে অনেকটা অটুট অবস্থায় রয়ে গিয়েছে ফলে সেই থেকে ব্রতের খাঁটি ও নিখুঁত চেহারাটি পাওয়া সহজ। ব্রতের অন্যতম অঙ্গ হল স্তুতি বা গান। পৌষ মাসের ‘তোষলা’ ব্রত’ই ধরুন না. এ ব্রত এখনও রাখে গ্রাম বাংলার মা মেয়েরা। দেখে নিন সেই ব্রতের স্তুতি বা গানের কথা.

‘তোষলা’ ব্রতকে কোথাও বলে ‘তুঁষতুষলি’। পূর্ববঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে দু জায়গায় এই ব্রতের চলন আছে।প্রতিদিন পৌষ মাসের সকালে মেয়েরা এই ব্রতটি করে।

নতুন সরায় বেগুনপাতা চাপা দিয়ে, সারমাটি নিয়ে মেয়েরা দলে দলে তোষলা ব্রত করতে ক্ষেতের দিকে যায় এবং সেখানে মূলোর ফুল, শিমের ফুল, সরষের ফুল দিয়ে ব্রত আরম্ভ করে।

প্রথম, তোষলার স্ততি–
তুঁষ-তুঁষলি,তুমি কে।
তোমার পূজা করে যে–
ধনে ধানে বাড়ন্ত,
সুখে থাকে আদি অন্ত।।
তোষলা লো তুঁষকুন্তি।
ধনে ধানে গাঁয়ে গুন্তি,
ঘরে ঘরে গাই বিঊন্তি।।

তাঁর পর অনষ্ঠান-উপকরণের বর্ণনা দেওয়া হয় সতুতুর মাধ্যমেই, যেমন–
গাইয়ের গোবর, সরষের ফুল,
আসনপিঁড়ি, এলোচুল,
গেয়ের গোবরে সরষের ফুল
ঐ ক’রে পূজিন আমার মা-বাপের কুল।

এর পরে মেয়েরা তোষলা ব্রতের কামনা জানায় আরেক স্তুতি দিয়ে —
কোদাল-কাটা ধন পাব,
গোহাল-আলো গোরু পাব,
দরবার-আলো বেটা পাব,
সভা-আলো জামাই পাব,
সেঁজ-আলো ঝি পাব,
ঘর করব নগরে,
মরব গিয়ে সাগরে,
জন্মাব উত্তম কুলে,
তোমার কাছে মাগি এই বর–
স্বামী পুত্র নিয়ে যেন সুখে করি ঘর।

তাঁরপর পৌষের সংক্রান্তির দিনে মেয়েরা সূর্যোদয়ের পূর্বে ব্রত সাঙ্গ করে একটি সরায় ঘিয়ের প্রদীপ জ্বেলে সেগুলি মাথায় নিয়ে সারি বেঁধে নদীতে স্নান করে তোষলা ভাসাতে যায়।
তখ এই গান করার নিয়ম–

       কুলকুলনি এয়ো রানী,
       মাঘ মাসে শীতল পানি,
       শীতল শীতল ধইলো,
       বড়ো গঙ্গা নাইলো।

       শীতল শীতল জাগে,
       রাই বিয়ে মাগে।
       আমাদের রায়ের বিয়ে
       ঝাম-কুর-কুর দিয়ে।

       বেগুনপাতা ঢোলা-ঢোলা
       রায়ের কানে সোনার তোলা।

এরপর নদীতে তোষলার সার ভাসিয়ে, তোষলার সারমাটি আর সূর্য, চাষের দুই প্রধান সহায়কে কৃতজ্ঞতা জানায় —

তোষলা গো রাই, তোমর দৌলতে আমার ছ_বুড়ি পিঠে খাই
ছ-বুড়ি ন-বুড়ি, গাঙসিনানে যাই, গাঙের বালিগুলি দুহাতে মোড়াই,
গাঙের ভিতর লাডুকলা ডবডবাতে খাই।
তুষলি গো রাঙ্গ,তুষলি গো ভাই,
তোমার ব্রতে কিবা পাই?
ছ-বুড়ি ছ-গণ্ডা গুলি খাই,
তোমাকে নিয়ে জলে যাই,
তুষ-তুষলি গেল ভেসে বাপ-মার ধন এলে হেসে
তুষ-তুষলি গেল ভেসে আমার সোয়ামির ধন এল হেসে।

এর পর, সূর্যর উদয় দর্শন করে, স্নান করে, ব্রতশেষে নদীতীরে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় বর্ণন করে ছড়া কাটা হয়–
রায় উঠছেন রায় উঠছেন বড়ো-গঙ্গার ঘাটে।
কার হাতে রে তেল-গামছা?দাওগো রেয়ের হাতে।
রায় উঠছেন রায় উঠছেন মেজো-গঙ্গার ঘাটে।
কার হাতে রে শাখা সিঁদুর দাওগো রেয়ের হাতে।
রায় উঠছেন রায় উঠছেন ছোটো-গঙ্গার ঘাটে।
রায় উঠছেন অন্নে, তামার হাঁড়ির বর্ণে,
তোমার হাঁড়ি, তোমার বেড়ি–
উঠ উঠ মা-গৌরী নিবেদন করি’।

এর পরে মেয়েরা ঘরে এসে পোষমাসের পিঠে খাবার আয়োজন করে যে ছড়া বলে–

       আখা জ্বলন্তি, পাখা চলন্তি,
       চন্দন-কাষ্ঠে রন্ধনঘরে,
       জিরার আগে তুষ পোড়ে,
       খড়িকার আগে ভোজন করে,
       প্রান স্বচ্ছন্দে নতুন বসতে
       কাল কাটাব মোরা জন্মায়স্তে।

তোষলা ব্রতের অনুষ্ঠানে, মা মেয়েরা হরির পাদপদ্মের পুজো দিয়ে বর চায় —
গিরিরাজ বাপ,
মেনকার মতো মা,
রাজা সোয়ামি,
সভা-উজ্জ্বল জামাই গুণবতী বউ,
রূপবতী ঝি,
লক্ষ্মণ দেবর, দুর্গার আদর—
‘দাস চান, দাসী চান, রুপার খাটে পা মেলতে চান,
সিঁথে সিঁদুর, মুখে পান, বছর-বছর পুত্র চান’।

আর চান—
‘পুত্র দিয়ে স্বামীর কোলে একগলা গঙ্গাজলে মরণ’ এবং “উষোতে পারলে ইন্দ্রের শচীপনা, না পারলে কৃষ্ণের দাসীগিরি’।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#West Bengal, #rituals, #toshla brata, #stutigaan

আরো দেখুন