BLO-দের মৃত্যু ‘প্রাতিষ্ঠানিক খুন’, নির্বাচনী সংস্কার নিয়ে রাজ্যসভায় সরব তৃণমূল সাংসদ

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি, ১৮:২১: আজ সোমবার, নির্বাচনী সংস্কার এবং ভোটার তালিকা সংশোধনে বুথ লেভেল অফিসারদের (BLO) উপর কাজের অতিরিক্ত চাপ নিয়ে রাজ্যসভায় সরব হলেন সাংসদ ঋতব্রত ব্যানার্জি। তিনি সরাসরি নির্বাচন কমিশন এবং কেন্দ্রীয় শাসকদলের দিকে আঙুল তুলে পশ্চিমবঙ্গের BLO-দের মৃত্যু ও আত্মহত্যার ঘটনাকে ‘প্রাতিষ্ঠানিক খুন’ বলে আখ্যা দেন।
রাজ্যসভায় নির্বাচনী সংস্কার নিয়ে আলোচনায় অংশ নিয়ে তৃণমূল সাংসদ ঋতব্রত ব্যানার্জি গ্রাউন্ড জিরোর বাস্তবতা তুলে ধরেন। তিনি জানান, বাস্তবে বহু ভোটারের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। তাঁর কথায়, কেউ আতঙ্কিত, কেউ অসুস্থ, আবার কেউ মৃত। ঋতব্রত ব্যানার্জির দাবি, ৪ নভেম্বর থেকে ১১ নভেম্বরের মধ্যে মাত্র ৩৭ দিনের ব্যবধানে ভোটার তালিকায় বহু নামের আগে বা পরে এই তিনটি শব্দই যুক্ত হয়ে গিয়েছে।
রাজ্যসভায় নির্বাচনী সংস্কার নিয়ে আলোচনায় অংশ নিয়ে তৃণমূল সাংসদ ঋতব্রত ব্যানার্জি আরও অভিযোগ করেন, ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনের আবহে গত ৪ নভেম্বর থেকে BLO-রা আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছেন। তাঁর কথায়, “মানুষের গণনা পর্বের শুরু থেকেই নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সুষ্ঠুভাবে কীভাবে শেষ করা যাবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।”
Rajya Sabha MP @RitabrataBanerj’s speech on Election Reforms pic.twitter.com/n3ommH0FFy
— AITC in Parliament (@AITC_Parliament) December 15, 2025
ঋতব্রত ব্যানার্জির দাবি, অতিরিক্ত কাজের চাপে কেউ কাজ ছেড়ে ধর্নায় বসেছেন, কেউ আবার হাতে ভাতের থালা নিয়ে হাঁপুস নয়নে কেঁদেছেন। তিনি বলেন, “অনেকে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যেতে বাধ্য হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে এ পর্যন্ত চারজন BLO মারা গিয়েছেন, আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। এগুলো প্রাতিষ্ঠানিক খুন।”
সাংসদের আরও অভিযোগ, “কেন্দ্রের শাসকদলের অঙ্গুলি হেলনেই নির্বাচন কমিশন চলছে। দু’বছরের কাজ দু’মাসে শেষ করতে গিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবেই এমন পরিণতি ডেকে আনা হয়েছে।”
তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের মতে BLO হলেন “friend, philosopher and guide of the local people”। কিন্তু বাস্তবে সেই বন্ধু, দার্শনিক ও পথপ্রদর্শকরাই কাজের চাপে ভীত, সন্ত্রস্ত, তটস্থ এমনকি মৃত হয়ে পড়ছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।
সাংসদের বক্তব্য, “কাজ শুরু হওয়ার চার দিনের মধ্যেই আমাদের রাজ্যে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ৯ নভেম্বর পূর্ব বর্ধমানের নমিতা হাজদা কাজের চাপে BLO হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মারা যান। এরপর জলপাইগুড়িতে কাজের চাপে চা বাগানের বাসিন্দা শান্তিমনি ওরাও প্রাণ হারান। ২১ নভেম্বর নদিয়ার কৃষ্ণনগরে BLO রিঙ্কু তরফদার আত্মঘাতী হন। ৫১ বছরের ওই BLO তাঁর সুইসাইড নোটে নির্বাচন কমিশনকে দায়ী করেছেন।”
তিনি আরও বলেন, “মুর্শিদাবাদে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে জাকির হোসেন নামে এক BLO-র মৃত্যু হয়েছে। রাজ্যে এমন কোনও জেলা নেই, যেখানে BLO-রা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যাননি। কেউ কাজ করতে বেরিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছেন, কেউ আবার বাড়িতে বসে BLO পোর্টালে নাম তোলার সময় জ্ঞান হারিয়েছেন।”
বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রসঙ্গ টেনে বিজেপিকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন তৃণমূল সাংসদ ঋতব্রত ব্যানার্জি। ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়া ঘিরে BLO-দের উপর চাপ এবং তার সামাজিক প্রভাব তুলে ধরে তিনি একে “ক্ষমাহীন ফলাফল” বলে আখ্যা দেন।
সাংসদের বক্তব্য, “গোটা নির্বাচনী সংস্কার মানুষের জীবনের মূল্যের বিনিময়ে করা হচ্ছে। BLO-দের উপর যে অমানবিক চাপ চাপানো হয়েছে, তা নজিরবিহীন। তাঁরা ডেটা রোবট নন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভেরিফিকেশনের জন্য অল্প সময় দেওয়া হয়েছে, যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। অধিকাংশ সময় BLO অ্যাপ কাজই করছে না।”
গ্রাউন্ড জিরোর অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে ঋতব্রত ব্যানার্জি বলেন, “দিনের বেলা BLO-রা কোনও তথ্য আপলোড করতে পারছেন না। রাত ১২টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত রাত জেগে আপলোড করতে হচ্ছে। এই নিয়ে কেউ অভিযোগ তুললেই তাঁদের disciplinary action-এর হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এটাই বাস্তবতা।”
নির্বাচনী সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা ও তাড়াহুড়ো নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। তাঁর কথায়, “এটা কি policy failure-এর hurry role? এই প্রশ্নের উত্তর মানুষ জানতে চান। সীমান্তবর্তী রাজ্য হলেও শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই কেন এই সংস্কার? আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড বা মনিপুরে কেন নয়?”
একই সঙ্গে বিজেপি নেতৃত্বের বিভিন্ন মন্তব্যের প্রসঙ্গ তুলে সাংসদ বলেন, “কেউ বলছেন ১ কোটি, কেউ ১০ কোটি, কেউ আবার ১ কোটি ২০ লক্ষ ভোটারের নাম বাদ যাবে। কীভাবে এই সংখ্যা বলা হচ্ছে? নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে রহস্যজনক নীরবতা পালন করছে। এতে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।”
রোহিঙ্গা প্রসঙ্গেও বিজেপিকে কটাক্ষ করে তিনি বলেন, “পৃথিবীতে ১৭ থেকে ১৮ লক্ষ রোহিঙ্গা আছে। বাংলায় ১ কোটি রোহিঙ্গা কোথা থেকে এল, সেটাই বোঝা যাচ্ছে না।”
SIR আতঙ্কে আত্মহত্যার অভিযোগ তুলে ঋতব্রত ব্যানার্জি জানান, “নরেন্দ্রনাথ রায় SIR আতঙ্কে আত্মহত্যা করেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখি, তাঁর পরিবারের সদস্যরা ২০২৩ ও ২০২৪ সালের ভোটার স্লিপ দেখাচ্ছেন। কিন্তু এবার enumeration form আসেনি। সেই আতঙ্ক থেকে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন ৪০ জন মানুষ।”
বক্তব্যের শেষে বাংলার বহুত্ববাদী সংস্কৃতির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “বিজেপি নেতারা বলার আগে বাংলা কখনও হিন্দু ভোটার, মুসলমান ভোটার শব্দ শোনেনি। আমাদের আমাদের ৫০০০ বছরের ডিএনএ, দু’হাজার বছরের ধ্রুপদী ভাষা, ১২০০ বছরের লিখিত ইতিহাসে এই বিভাজনের ভাষা নেই।” কবিতার পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, “আমি আজান দিয়ে থাকি, আমি যীশুখ্রিস্টের পায়ে নত… আমি বাঙালি হলাম।” বক্তব্যের শেষ করেন “জয় হিন্দ, বন্দেমাতরম, জয় বাংলা” স্লোগানে।