মুখোমুখি নন্দীগ্রামের ‘শহিদ মা’ ফিরোজা বিবি
আজ ১৪ই মার্চ। ২০০৭ সালের এই অভিশপ্ত দিনেই পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান ১৪ জন প্রতিবাদী মানুষ। আজকের এই ঐতিহাসিক দিনে দৃষ্টিভঙ্গির মুখোমুখি নন্দীগ্রামের ‘শহিদ মা’ ফিরোজা বিবি (Firoja Bibi)।
প্রশ্ন: ২০০৭ – এর নন্দীগ্রাম বিপ্লবে ছেলে শেখ ইমদাদুলকে হারালেন। কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। নির্বাচন আসন্ন। কি মনে হচ্ছে এবারের নির্বাচনে কি হতে পারে?
ফিরোজা বিবি: সাধারণ বিবেক দিয়ে বুঝি, নির্বাচনে লড়াইটা জোরদার হবে। জোরদার হবে, কারণ পয়সার জন্যেও তো কিছু মানুষ বিকিয়ে যায়। তবে তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃতীয়বারের জন্যে আসছে। এটা আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি। ঈশ্বর, আল্লা বা ভগবানের ওপর ভরসা রেখে আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি।
জাতি বলতে আমি বুঝি নারী ও পুরুষ। ধর্মের মধ্যে জাতিভেদ আমি বুঝি না। সবাই মনের আনন্দে যে যার ধর্ম পালন করুক। ধর্ম নিরপেক্ষতা মুছতে বসেছে। আমাদের দেশে প্রধাণ রয়েছে সনাতন ধর্ম এবং ইসলাম ধর্ম। আমরা এক পুকুরে স্নান করি, এক মাঠের ফসল খাই। এই যে বিভাজন সাম্প্রদায়িকতার। মাদ্রাসা তুলে দেব, শ্মশানে পাঠিয়ে দেব, কোন মসজিত থাকবে না, এইসব কথা আমরা মেনে নিতে পারি না।
পয়সা যতোই থাকুক মানুষের মূল কথা মানুষের বিবেক, মানুষের ধর্ম, মানুষের মানসিকতা, সচেতনতা। মানুষ এখন সচেতন। আগেকার দিনের মানুষের লেখা পড়া কম ছিল। মানুষ আগে শুধু খাটাখাটনি করত, আর সংসার করত। এখন মানুষ পড়াশোনা জানে। আমাদের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁকে আমি সম্মান করি। তিনি নারী জাতীর মহামান্য, গৌরবময়ী দার্শনিক মা।
প্রশ্ন: আপনি নন্দীগ্রাম আন্দোলনে ছেলেকে হারিয়েছেন। সবাই বলতেন শুভেন্দু অধিকারি আপনার ছেলে। সেই ছেলে বিজেপিতে চলে গেল। কি বলবেন?
ফিরোজা বিবি: মানুষ কি বলে সেটা বড় কথা না। আপনি আমার মেয়ের বয়সী আপনাকে আমি মেয়ে বলতেই পারি। কিন্তু ছেলে ছেলেই থাকে। মানুষকে মানুষের সম্মান দিতেই হয়। আমরা সবাইকে সম্মান দিই। এটাই আমাদের সংস্কৃতি। শুভেন্দু নন্দীগ্রামে মিটিং, মিছিলে সময় অসময়ে আসত, পরিচিতি ছিল, এটাই আমরা জানি।
সবাই জোর করে বলত আমার ছেলে। আমি কখনো আমার ছেলে তার ছেলে করিনি। আমি একটা কথাই বলি আমি একটা ছেলেকে হারিয়ে লাখ লাখ ছেলে পেয়েছি। কারো নাম নিই না। শুভেন্দু বিজেপিতে গেছেন আমার সে বিষয়ে কিছু বলার নেই। সে তার বিবেচনা অনুযায়ী গেছে।
প্রশ্ন: শুভেন্দু অধিকারির অনুগামীরা আপনার জন্য অনেক কাজ করেছেন। এখন তাঁর চলে যাওয়াটা কি কোনভাবে ভোট বাক্সে প্রভাব ফেলতে পারে?
ফিরোজা বিবি: আমি আশা করি কোন রকম প্রভাব ফেলবে না। এখন মানুষ অনেক সচেতন। মানুষ সাম্প্রদায়িকতাকে পছন্দ করে না। মানুষ সৌহার্দ, স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে ভালোবাসে। ব্রিটিশ আমলের কথা আমি জানি না। কিন্তু ২০০৭ সালে আমি সেই লড়াই দেখেছি। সিপিএম- এর লড়াইও আমি দেখেছি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো এরকম দয়ালু মুখ্যমন্ত্রী আর নেই।
আজকাল শিশু কন্যাদের বিয়ে হয় না, উনি কন্যাশ্রী দিয়েছেন বলে। মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের বিয়ে আটকে দেয়। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ওনার প্রকল্পের শেষ নেই। আমি যখন প্রথম এমএলএ হয়ে আসি তখন এইরকম রাস্তা ঘাট ছিল না। জলের কোন ব্যবস্থা ছিল না। পুকুরের জল তুলে নিয়ে আমরা ফিটকিরি দিয়ে বা গরম করে খেতাম। আজকে ঘরে ঘরে পানীয় জলের ব্যবস্থা, বিদ্যুতের বাতি, রাস্তাঘাট।
আমাদের ছেলে মেয়েরা যখন নন্দীগ্রামে পড়তে যেত, কাঁধে করে সাইকেল নিয়ে যেত। ঘর থেকেই এখন মানুষ সাইকেল, বাইক নিয়ে যায়। মানুষ যদি এইসব ভুলে যায় তাহলে বলার কিছু নেই। ভগবান আছে মাথার ওপরে। শততাই মূল ধন। শততা যদি থাকে তাহলেই হবে।
কিছু মানুষ তো যাবেই। সবরকম মানুষই তো থাকে। আমার হাতের আঙুলও পাঁচটা সমান না। রাত, দিন দুটোই থাকবে। এটা থাকলে আরো ভালো। লড়াই করে যে উনি জিতবেন নন্দীগ্রামে এটাই সব থেকে ভালো আমার কাছে।
প্রশ্ন: ২০০৭ সালে যখন ছেলেকে হারান, সেই সময়ের কথা একটু বলবেন?
ফিরোজা বিবি: আমি যখন ১৯৯৮ সালে প্রথম তৃণমূলের হয়ে যখন আমি গ্রাম পঞ্চায়েতে লড়ি, তখন কেউ হাতে খরি দেওয়ার মতো ছিল না। আমার স্বামী তখন কলকাতাতে থাকতেন। ওনার অনুমতি নেওয়ার অপেক্ষাও করিনি। আমাকে এসে বলল তুমি তো সবসময় ডানপন্থী কর তোমাকে দাঁড়াতে হবে। আমি বললাম বাড়িতে তো কেউ নেই। তখন বলল আমরা বুঝে নেব। আমি সেই জন্ম লগ্ন থেকেই তৃণমূলের সাথে আছি।
আমি তারপরে পর পর হেরে যাই। যখন দল শক্ত পোক্ত হল, অনেকে এল এসে বলল ওনার কি অবদান আছে। যে ওনাকে দাঁড় করাতে হবে। আমার আক্ষেপ হল। আমি ছেড়ে দিলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল আমার দলকে জেতানো। তাদের বললাম আমি ৩৬ টা ভোটে হেরেছিলাম। তোরা জেত। কিন্তু জেতা তো দূরের কথা ওরা অনেক ভোটে হেরে গেল। তারপরে এলো ২০০৮ সাল। ২০০৬ সালে সিপিএম সরকার জিতে এলো। জমি জায়গা বাড়ি ঘর সব নিয়ে নেবে। তখন কিন্তু আমরা ভাবিনি এইভাবে লড়াইটা হবে। ২০০৭- এর সেই দিনটা ছিল কুর্বানির দিন। আমাদের বাড়িতে প্রতিবছর কুর্বানি হয়। আমরা সবাই তখন ক্লান্ত।
২০০৭ সালের ২রা জানুয়ারি একজন এসে বলল, মা আমাকে কিছু পয়সা দিও মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি তো! হাড়ি কুড়ি দিতে পারিনি বলে আমার মেয়ের ওপর অত্যাচার করছে। আমি বললাম তুমি এসো। আমাদের কিছুটা মাংস রেখে পুরোটাই দান করতে হয়। আমি দুহাতে টাকা ভাগ করেছি। এটা দেব, আবার চাইলে বাকিটাও দেব এই ভেবে। মেয়েটা এসে কাঁপতে কাঁপতে বলছে আমাকে তাড়াতাড়ি দাও। আমার ছোট ছেলে ক্রিকেট খেলত। অধিনায়ক ছিল। এমন সময় আওয়াজ এলো রাজা তোমার টিম নিয়ে মাঠে নেমে পড়।
সেদিন আমার পুকুরে অনেক পাবদা মাছ উঠেছে। আমি বললাম আর তুলতে হবে না। হঠাত একটা বোমের আওয়াজ এলো। দেখলাম ধোয়া আর আগুন। এর আগে এসব আমরা চিনতাম না। সেদিন তিনজন আহত হল এখানে। আমি খুঁজছি আমার ছেলেটা কোথায়। আমার ছেলেটা ডানপিটে ছিল। সিপিএমের জমানা ছিল, কিন্তু ও কাউকে পরোয়া করত না। আমি গেলাম খুঁজতে সবাই আমাকে ফিরিয়ে দিল।
সেই থেকে শুরু আমাদের লড়াই। মুসলিমদের বাড়িতে শাঁখ আর হিন্দুদের বাড়িতে কাসর ঘন্টা বাজিয়ে শুরু হল লড়াই। ৭ তারিখে ভাঙ্গাবাড়ায় তিনজন শহীদ হল। সেই থেকে আমরা এদিক ওদিক যাই আর রাতে বাড়িতে ফিরি। এভাবেই ২০০৯ সালের লোকসভা ভোট অবধি চলে এই লড়াই।
প্রশ্ন: এখন পরিস্থিতি তো অনেক বদলেছে?
ফিরোজা বিবি: আমরা এখন খুব শান্তিতে আছি। তবে বিজেপি সরকার আসার জন্যে দূরে মাঝে মধ্যে গন্ডগোল হয়।
প্রশ্ন: মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন নন্দীগ্রাম থেকে প্রার্থী হবে। সেটা কি নন্দীগ্রামবাসীর জন্যে সুখবর?
ফিরোজা বিবি: শুধু নন্দীগ্রামবাসীর জন্যে সুখবর না। মুখ্যমন্ত্রী নন্দীগ্রাম থেকে মন্ত্রী হবেন এর থেকে আর সৌভাগ্য কি হতে পারে! এটাই তো বড় পাওনা।
প্রশ্ন: শুভেন্দুর চলে যাওয়া প্রভাব ফেলবে না?
ফিরোজা বিবি: আমি মনে করি না। কিছু আছে, কিছু যাবে তাই বলে সবাই চলে যাবে না।
প্রশ্ন: আপনি মনে করছেন নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই জয়ী হচ্ছেন?
ফিরোজা বিবি: আমি একশো শতাংশ আশা রাখি।
প্রশ্ন: নন্দীগ্রামে যে লড়াইটা হয়েছিল সেটা নিয়ে কি বলবেন?
ফিরোজা বিবি: নন্দীগ্রামের লড়াই নন্দীগ্রামের মানুষই করেছিল। সেইসঙ্গে আরো একটা কথা বলি ২০০৭- এর ৭ জানুয়ারি যারা শহীদ হল। আমার ছেলে ১৪ মার্চ শহীদ হয়েছিল। ছেলের বডি পাইনি। সহযোগীতা কেউ করেনি। যেদিন আমার ছেলের কাজ হবে সেদিন শুভেন্দু বাবু আমাদের বাড়ি এসেছিলেন। সেই প্রথম এবং শেষ আসা।
সবাই বলে আমি নাকি শুভেন্দুর মা। আমি সবাইকেই ছেলের মতো ভালোবাসি এটাই আমার সংস্কৃতি। ঘরে আগুন লেগে আগুন ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার পর নেতারা এসে সহানুভূতি দেখায়। তখন দোলা দি, নেত্রী, পার্থ দা এসেছেন। আমার বাড়িতে কেউ আসেননি। ২০১৬ তে ছেলের বডি পাওয়ার আমার স্বামী বলেন আমরা দুজনেই বেঁচে আছি। আমাদের ছেলের কাজ হবে না! কবে থাকবনা জানিনা, তার কাজ আমি করব।
আবার কেউ কেউ বলেছে এই গন্ডগোলে কি করে কাজ হবে! আমরা বলেছি, না কাজ হবে। সেইদিন শুভেন্দু অধিকারি আসেন। লোকের মুখকে তো ধরে রাখা যায় না। আমার ছেলে বা জামাই যেমন জীবন মরন পন করে আমার ছেলের বডি খুঁজতে গেছিল সেটাও যেমন ঠিক, রেয়াপাড়ায় ঘিরে রেখেছিল। মেরেই ফেলত। আমার ছেলের ডেথ সার্টিফিকেটের বিষয়ে কেউ সহযোগীতা করেনি। নিজের চেষ্টাতেই স্বামী ছেলের ডেথ সার্টিফিকেট বের করে আনল। বাকিরাও এসে বলল আমাদের ছেলে- ভাইয়ের ডেথ সার্টিফিকেট এনে দাও। এরকম করে অনেকেরই ডেথ সার্টিফিকেট ও বের করে দিল। তখন কারোর সহযোগীতাই আমি পাইনি।
দিদি শুভেন্দু অধিকারিকে এখানকার একচ্ছত্র রাজা করেই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। যা কিছু করবে শুভেন্দু করবে। শুভেন্দুই করত। ছেলে মেডিক্যাল লাইনে না থাকলে ছেলের বডিও পেতাম না। মাথা কুটে মরতে হত।