শহরের দেওয়াল কথা বলছে, কিন্তু মানুষ কি শুনছে?
শহরের ব্যস্ততম রাস্তা হেস্টিংস পার্ক রোড, আলিপুর। কোণের দিকে জার্মান কনস্যুলেটের দপ্তরআর তারই পাঁচিল জুড়ে রয়েছে সারি সারি মেয়ের অবয়ব। চারিদিকের ব্যস্ততার মাঝে যেন তারা আটকে পড়েছে সেখানেই। কোনওটা গাঢ়, আবার কোনওটা একেবারে ফিকে হয়ে গিয়েছে। আদতে যা বোঝাচ্ছে তা হল প্রতি বছর অনেক নারীর ‘হারিয়ে’ যাওয়া।
স্বল্প বা অতি চেনা পরিচিতর হাত ধরে এমন জায়গায় পাচার হতে যায়, যেখান থেকে ফেরার পথ থাকে না। লীনা কেজরিওয়াল শুরু করেছিলেন এই গ্রাফিতি। শহরের বিভিন্ন দেওয়ালে স্টেনসিল দিয়ে এ রকম নারী অবয়ব এঁকে হ্যাশট্যাগ দিয়ে মিসিংগার্লস লেখা থাকে। নারী পাচারের বিরুদ্ধে ২০১৫ থেকে কাজ করছেন লীনা। তাঁর কাজের পরিধি বেড়েছে। আর সেই গ্রাফিতিই ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে। রাস্তায় যাঁরা যাতায়াত করছেন, যাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এই প্রচেষ্টা।
গল্ফগ্রিনের বাস স্ট্যান্ডের দেওয়াল – চায়ের দোকান, মিনিবাসের ভিড়ের ফাঁক থেকে উঁকি মারছে কিছু গ্রাফিটি। বিষয় পরিবেশ আর নারী স্বাধীনতা। কোথাও বায়ুদূষণ, কোথাও শব্দ দূষণের কথা তুলে ধরা হয়েছে এখানে। পৃথিবী যে ক্রমশ কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হচ্ছে তাও ফুটে উঠেছে শিল্পীর তুলিতে। এখন থেকেই জল সঞ্চয় না করলে ভবিষ্যতে যে ভয়ঙ্কর সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে, সেই বার্তাও দিচ্ছে এখানকার দেওয়ালচিত্র।
ছবিগুলো তেলরঙে এঁকেছেন শিল্পী সুব্রত বসু। পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গে নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথাও তুলে ধরেছেন তিনি। মেয়েদের পড়ালে তবেই নারী স্বাধীনতা সম্ভব, নারী স্বনির্ভরতা সম্ভব। আর শিক্ষা ছাড়া যে উন্নতির কোনও পথ নেই সে তো বলাই বাহুল্য।
এরকমই নারী মুক্তির কিছু ছবি দেখা যায় বালিগঞ্জ ট্রামডিপোর দেওয়ালেও। সহজ ছবিতে তুলে ধরা হয়েছে নারী স্বাধীনতার নানা রূপ।
শহরের অন্যপ্রান্ত এজেসি বোস রোডের লা মার্টিনিয়ার স্কুল। যার দেওয়াল জোড়া গ্রাফিটি নজর কেড়েছে অনেকেরই। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচুর শেয়ারও হয়েছে এই ছবি। কোথাও বডি শেমিং-এর বিরুদ্ধে বার্তা, আবার কোথাও সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে নিজেদের সুরক্ষিত রাখার আহ্বান। অন্যকে নয়, নিজের বাড়ির মেয়েটিকে বিশ্বাস করতে হবে সবার আগে। বা নিজের মতামত প্রকাশ করা থামালে চলবে না—এ রকমই ছোট ছোট সহজ অথচ গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা হয়েছে ছবির আর লেখার মাধ্যমে।
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘স্বয়ম’, ‘সারভাইভার’ মেয়েদের আর লা মার্টিনিয়ার স্কুলের ছাত্রীদের নিয়ে আলাদা আলাদা দুটি ওয়ার্কশপ করে। সেই ওয়ার্কশপে যে ধরনের চিন্তাভাবনা বা স্লোগান উঠে আসে তাই শিল্পীরা আঁকেন দেওয়ালটিতে। সুমন্ত্র মুখোপাধ্যায়, রেমিল বর্গি আর অনুপ প্রামাণিক করেছেন এই গ্রাফিতি। কোন কোন জায়গাগুলো নিরাপদ নয়, সে গুলো কীভাবে নিরাপদ করা সম্ভব তাও উঠে এসেছে এই দেওয়ালচিত্রের মাধ্যমে। এই গ্রাফিটিতে সই করেছেন প্রচুর মানুষ, ছাত্র-ছাত্রী।
গ্রাফিটির সামনে কেউ সেলফি তুলছেন। কেউ আবার হেঁটে যাচ্ছেন ভিডিওকল করতে করতে। কেউ কেউ বুঝতেই পারছেন না বিষয়টা ঠিক কী। তবুও এর মধ্যেই কিছু মানুষ দেখছেন, ভাবছেন, এই নিয়ে কথা বলছেন। এটাই বা কম কী? কোনও বার্তা দিতে শহরে, দেওয়ালের থেকে বড় মেসেজ বোর্ড আর কী বা হতে পারে।