খেলা বিভাগে ফিরে যান

স্মৃতির স্মরণীতে মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গল

November 27, 2020 | 4 min read

আজ ফের একটা বড় ম্যাচ । আর ঘণ্টাখানেক পরেই গোয়ার তিলক ময়দানে মুখোমুখি হবে এটিকে মোহনবাগান আর এসসি ইস্টবেঙ্গল।

বাঙালির আবেগের সঙ্গেই জড়িয়ে ইস্ট-মোহন। ময়দানের এই দুই হেভিওয়েটের চিরাচরিত প্রতিদ্বন্দ্বীতা ডার্বি নামেই পরিচিত। শেষ ৯৪ বছরের ইলিশ-চিংড়ির লড়াই নিছক ম্যাচের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। তৈরি করে নিয়েছে নিজস্ব একটা ব্র্যান্ড। হয়ে উঠেছে চলমান ইতিহাসের জ্বলন্ত দলিল।

যাঁরা পরিসংখ্য়ান ভালবাসেন, তাঁদেরকে একবার জানিয়ে দেওয়া যাক যে, ৩৭২তম কলকাতা ডার্বি হতে চলেছে এটি। ১২৯ বার জিতেছে ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান জিতেছে ১২০ বার। দুই দলের মধ্য়ে ড্র হয়েছে ১২২ বার।

ডার্বির ডাইরিতে আজীবন থেকে যাবে বেশ কয়েক’টি স্মরণীয় ম্যাচ। তারই কিছুর বর্ণনা রইলো এখানে।

মোহনবাগান ০ -১ ইস্টবেঙ্গল, কলকাতা লিগ, ১৯২৫

সালটা ১৯২৫। সেবারই প্রথমবার ইস্ট-মোহন মুখোমুখি হয়েছিল৷ মোনা দত্তের নেতৃত্বে ১-০ ম্যাচ জিতে নিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল৷ ম্যাচের একমাত্র গোলটি এসেছিল নেপাল চক্রবর্তীর পা থেকে। এখান থেকেই শুরু ডার্বির পথ চলা। কোনও শহরের দু’টি প্রধান দল সন্মুখ সমরে আসলেই তা ডার্বি বলে গণ্য করা হয়। সেক্ষেত্রে কলকাতার তিন প্রধান ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান ও মহামেডান একে অপরের সঙ্গে খেলা মানেই ডার্বি বা বড় ম্যাচ। কিন্তু ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের ফুটবলের লড়াইয়ে মিশেছে আবেগের অনেক স্তর। ঘটি-বাঙাল ফ্যাক্টারটাই যদিও এখানে মুখ্য। সেক্ষেত্রে ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে মহামেডান বা মোহনবাগানের সঙ্গে মহামেডানের ম্যাচ ধীরে ধীরে মিনি ডার্বির তকমা পেয়ে গেছে। লাল হলুদ-মেরুন সবুজের ফাটাফাটি ‘রাইভালরি’আর সাত বছর পরেই সেঞ্চুরি স্পর্শ করবে। ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয় ফুটবল ফ্যানাটিকদের।

মোহনবাগান ৩-১ ইস্টবেঙ্গল, আইএফএ শিল্ড ফাইনাল ১৯৬৯

এক সময় আইএফএ শিল্ডই ছিল ভারতের সবচেয়ে বড় ফুটবল প্রতিযোগিতা। গৌরবের ডানায় ভর করেই এগিয়ে গিয়েছিল এই টুর্নামেন্ট। ১৯১১-তে এই টুর্নামেন্টের ফাইনালেই ইস্ট ইয়র্কশায়ারকে হারিয়ে মোহনবাগান ভারতীয় ফুটবলের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। বুট পরা বিদেশিদের বিরুদ্ধে খালি পায় খেলেই অমর একাদশে নিজেদের নাম লিখিয়েছিলেন শিবদাস ভাদুড়ি, অভিলাষ ঘোষ ও কানু রায়রা। এ কথা প্রায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরেই প্রবাহিত হচ্ছে।
৬৯-এ সেবার অমল দত্ত মোহনবাগান দলে ট্যাকটিকাল নতুনত্ব এনেই চমকে দিয়েছিল। ২-৩-৫ ছকের বদলে ৪-২-৪ ছকেই খেলাচ্ছিলেন তিনি। উইংব্যাকরা ওভারল্যাপে গিয়ে ফরোয়ার্ডদের গোল করতে সাহায্য করবে। এটাই ছিল ডায়মন্ড কোচের ভাবনা। সবুজ মেরুনে যেটা দুরন্ত কাজ করেছিল। কিংবদন্তি ভারতীয় গোলকিপার পিটার থঙ্গরাজ সেদিন ইস্টবেঙ্গলের তে-কাঠির নীচে ছিলেন। কিন্তু প্রণব গঙ্গোপাধ্যায়কে আটকাতে পারেনি তাঁর বিশ্বস্ত দস্তানা। স্কোরশিটে নাম লিখিয়েছিলেন সুকল্যাণ ঘোষ দস্তিদারও। লাল হলুদ ডিফেন্স নিয়ে ওই ম্যাচে ছেলেখেলা করেই ট্রফি ঘরে তুলেছিল মোহনবাগান।

ইস্টবেঙ্গল ৫-০ মোহনবাগান, আইএফএ শিল্ড ফাইনাল ১৯৭৫

৯৭ বছরের ডার্বির ইতিহাসে ৭৫-এর শিল্ড ফাইনাল আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ছ’বছর পর শিল্ড ফাইনালে মধুর প্রতিশোধ নিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। ফাইনালে মোহনবাগানকে পাঁচ গোলের মালাই পরিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। কোনও দলের এখনও পর্যন্ত ডার্বিতে এটাই সবচেয়ে বড় ব্যবধানে জয়।ম্যাচের প্রথমার্ধেই ইস্টবেঙ্গল ৩-০ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল। তাও আবার পেনাল্টি মিস করেই। সুরজিত সেনগুপ্ত, শ্যাম থাপা ও রঞ্জিত মুখোপাধ্যায় স্কোরশিটে নাম লিখিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ার্ধেও ইস্টবেঙ্গলের আগুনে ফর্ম অব্যাহত ছিল। শ্যাম থাপা দ্বিতীয়ার্ধের ৫১ মিনিটে নিজের দু’নম্বর ও ম্যাচের চার নম্বর গোলটি করেছিলেন। ৮৪ মিনিটে শুভঙ্কর স্যান্নাল বাগানের কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতে দিয়েছিলেন।
ডার্বি হেরে বাগান সমর্থকরা নিজেদর আর সংযত রাখতে পারেননি। মোহনবাগানের তাঁবু ঘিরে রেখেই প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তাঁরা। এমনকী ফুটবলারদের বেরোতে পর্যন্ত দিচ্ছিলেন না উত্তপ্ত সমর্থকরা। সুব্রত ভট্টাচার্য ও প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় ক্লাবের পিছনের গেট দিয়েই পালিয়ে গিয়েছিলেন। ফ্যানেদের রোষের মুখ থেকে বাঁচতে তাঁরা সারারাত গঙ্গার বুকে নৌকাতেই কাটিয়েছিলেন। ডার্বিতে হারের জ্বালা সহ্য করতে না-পেরে কট্টর বাগান সমর্থক উমাকান্ত পালোধি আত্মহত্যাও করেছিলেন। সুইসাইড নোটে লিখে গিয়েছিলেন যে, পরের জন্মে বাগানের ফুটবলার হয়েই এই হারের প্রতিশোধ নেবেন তিনি।

ইস্টবেঙ্গল ৪-১ মোহনবাগান, সেমিফাইনাল, ফেডারেশন কাপ ১৯৯৭

১৯৯৭-এর ১৩ জুলাই ফেডারেশন কাপের সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান। এই ম্যাচ দেখতে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে এসেছিলেন ১ লক্ষ ৩১ হাজার দর্শক৷ যা এখনও পর্যন্ত রেকর্ড৷ বাইচুং ভুটিয়ার হ্যাটট্রিকে মোহনবাগানকে ৪-১ হারিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল৷ মোহনবাগানের হয়ে একমাত্র গোলটি করেছিলেন চিমা ওকোরি৷ সেসময় নতুন ডায়মন্ড সিস্টেম নিয়ে অমল দত্ত পরীক্ষা নীরিক্ষা করছিলেন। বিপক্ষের বক্সে আক্রমণের ঝড় তুলছিলেন বাগানের ফুটবলাররা। এমনকী অমল দত্ত ম্যাচের আগে থেকেই মাইন্ড গেমও শুরু করে দিয়েছিলেন। বাইচুংকে ‘চুং চুং’ বলেও ডেকেছিলেন তিনি। যদিও লাল হলুদ কোচ পিকে বন্দ্যোপাধ্যায় এসব নিয়ে কোনও মাথাই ঘামাননি। ম্যান ম্যানেজমেন্টের মাস্টার ছিলেন তিনি। দলের পারফরম্যান্সে আগুন জ্বালাতে জানতেন ধুরন্ধর পিকে। যুযুধান দুই কোচের মস্তিষ্কের লড়াইয়ে শেষ হাসি তিনিই হেসেছিলেন।

মোহনবাগান ৫-৩ ইস্টবেঙ্গল, আই-লিগ ২০০৯

৭৫-এর আইএফএ শিল্ড ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলের কাছে পাঁচ গোলে হেরেই মাথা নীচু করে মাঠ ছাড়তে হয়েছিলমোহনবাগানকে। ৩৪ বছর ধরে বাগান সমর্থকদের সেই যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে মুখ বুজেই। ইস্টবেঙ্গল সুযোগ পেলেই হাতের পাঁচ আঙুল দেখিয়েই মোহনবাগানিদের ব্রিদ্রুপ করত। কিন্তু ২০০৯-এ এর উত্তর দিয়েছিল মোহনবাগান। ১৯৭৫ এর ৫-০ র বদলা ৫-৩ এ নিয়েছিল মোহনবাগান। এই ম্যাচে একাই শেষ করে দিয়েছিলেন চিডি এডে। চার গোল করেছিলেন তিনি। ২৫ অক্টোবর যুবভারতীতে আরও একটা নজির গড়েছিলেন এই নাইজেরিয়ান স্ট্রাইকার। একমাত্র বিদেশি ফুটবলার হিসেবে ডার্বিতে হ্যাটট্রিক করেছিলেন তিনি৷ পাশাপাশি কোনও ডার্বিতে সর্বোচ্চ গোল করারও নজির গড়েন তিনি ৷ এই ম্যাচের ন মিনিটে শিল্টন পালের ভুলেই প্রথমে বাগান গোল হজম করেছিল। নির্মল ছেত্রীর ফ্লাইট বুঝত পারেননি শিল্টন।এরপর চিডি সমতা ফেরান। মণীশ মাথানির গোলে স্কোরলাইন ৩-১ হয়েছিল। এরপর ব্যারেটোর মাপা ক্রস থেকেই চিডি নিজের দু নম্বর ও দলের হয়ে তিন নম্বর গোলটা করেছিলেন। রুদ্ধশ্বাস ম্যাচে দুরন্ত পত্যাবর্তন করেছিল ইস্টবেঙ্গল। প্রথমার্ধের আগেই ইয়াসুফ ইয়াকুবু বাগানের দুর্বল রক্ষণের সুযোগ নিয়ে জোড়া গোল করে স্কোরলাইন ৩-৩ করেন। দ্বিতীয়ার্ধেও চিডি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি ফুরিয়ে যাননি। আরও দুটি গোল করে ইস্টবেঙ্গলকে ম্যাচ থেকে ছিটকে দিয়েছিল।

ইস্টবেঙ্গল ৩-০ মোহনবাগান, আই লিগ ২০১২

২০১২-র আই-লিগের এই ম্যাচটার কথা কারোর পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। ১৯৮০-র ১৬ অগস্টের ইডেনের স্মৃতিই ফিরে আসতে চলেছিল যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে। প্রথমার্ধেই ঘটে গিয়েছিল একের পর এক ঘটনা। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানেই বাগানের তিন জন খেলোয়াড় হলুদ কার্ড দেখেছিলেন। এখানেই শেষ নয়, ওডাফা ওকোলিকে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল। আর এসব দেখেই মাথা ঠিক রাখতে পারেনি দর্শকরা। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে গ্যালারিতে। পরিস্থিতি সামাল দিকে পুলিশ লাঠিও চালিয়েছিল। এসবের মধ্যোই গ্যালারি থেকে আঁধলা ইঁট উড়ে এসেছিল রহিম নবির মাথায়। রক্তাক্ত নবি ইস্টবেঙ্গল ফুটবলারদের কাঁধে চেপেই মাঠ ছেড়েছিলেন সেদিন। পরে তিনি বলেছিলেন যে, এরকম দর্শকরা যেন মাঠে না আসে। দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে না নামার জন্য মোহনবাগানকে দু বছর নির্বাসিত করা হয়েছিল। যদিও পরে সাসপেনশন উঠে যায়। ইস্টবেঙ্গলকে ম্যাচটা ৩-১ গোলের জয়ী ঘোষণা করা হয়। আজ ফেরা একটা ডার্বি। আরও একটা ইতিহাসের অপেক্ষায় ডার্বি।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#East Bengal Club, #Mohun Bagan fc

আরো দেখুন