রাজ্য বিভাগে ফিরে যান

দিদি থেকে বাংলার মেয়ে, পঁচিশে তৃণমূল : এক আগুন পাখির যাত্রা

January 1, 2022 | 7 min read

সৌভিক রাজ

১৯৯৮, ১ লা জানুয়ারী থেকে ২০২২, ১লা জানুয়ারী; মাঝে কেটে গেল চব্বিশটি বছর। ভারতীয় রাজনীতি পুরুষতান্ত্রিক। মুখে মুখে নারী ক্ষমতায়ণের কথা বললেও একটি উন্নয়নশীল দেশে কাজে কতটা কী করে, তা আমাদের সকলের জানা। যে সময়ের কথা তখন ইন্দিরা গান্ধী ইতিহাসের মানুষ। পরবর্তী ঠিক সময়ে দক্ষিণে জয়ললিতা ছিলেন, হিন্দি বলয়ে মায়াবতী কিন্তু জাতীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করার জায়গায় তারা পৌঁছাতে পারেননি। জয়ললিতা মারা গিয়েছেন, মায়াবতীও তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছেন।


সেই ভারতেরই অন্যতম বড় রাজ্য পশ্চিম বাংলা। আর এই রাজ্যের একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিই বর্তমানে গোটা দেশের একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রী। আন্দোলন করতে করতে উঠে আসা, সক্রিয় জাতীয় রাজনীতির একমাত্র নেত্রী তিনি। এই মুহূর্তে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় দেশের সবচেয়ে প্রবীণ রাজনীতিকের নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর শুরুটা আমাদের সকলের জানা, জীবনের প্রথম লড়াইতেই তিনি জায়েন্ট কিলার! আর তারপর বাকিটা ইতিহাস।


আন্দোলন আর লড়াইয়ের প্রতিশব্দ হলেন মমতা, তিনি অগ্নিকন্যা, স্ট্রিট ফাইটার সকলের দিদি। বিরোধিতায় তাঁর জুড়িমেলা ভার।


বাংলার রাজনীতি এক কেন্দ্রীক, এমন মনোপোলিস্টিক রাজনীতি ভারতের আর কোথাও দেখা যায় না। বাংলার রাজনৈতিক সচেতন জনগণ চট করে রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটাতে চান না। স্বাধীনতার পরে তিন দশকের কংগ্রেস, তারপরে সাড়ে তিন দশকের বাম শাসন, সময়কালগুলোই বলে দেয় বাংলার মানুষের মন পরিবর্তনপন্থী নয়। অপশাসন-রাজনৈতিক অরাজকতা দীর্ঘদিন চললে তবেই সে ভোটবাক্সে পরিবর্তনের পক্ষে ভোট দান করে। তবে মানুষের মত পরিবর্তনের কান্ডারি হতে হয় বিরোধী দলকেই, বিরোধীদের শক্তিশালী ধারাবাহিক আন্দোলন জনতার মত পরিবর্তনে অনুঘটক রূপে কাজ করে।


বামপন্থীরা ধারাবাহিকভাবে বাংলায় ভোট বাড়াচ্ছিলেন, কংগ্রেস যোগ্য বিরোধী দলের ভূমিকা পালনে পুরোপুরি ব্যর্থ!এমতাবস্থায় বাংলার প্রতিষ্ঠান বিরোধী ভোটারদের জন্য একটি তৃতীয় শক্তির উঠে আসা একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সেটাই হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গড়লেন দল, কিন্তু লড়াইতে কাঙ্খিত সাফল্য এল না। ২০০১ মরণ বাঁচন লড়াইয়ের ডাক দিলেন মমতা কিন্তু এবারেও অধরা থেকে গেল জয়। ওদিকে জাতীয় রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকতা বাড়িয়ে চলেছেন দিদি। ২০০৬ এর নির্বাচন বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ফিরল বামেরা, তৃণমূলের গ্রাফ নিম্নগামী! হয়ত অন্য কোন রাজনৈতক দল হলে সে সময়তেই শেষ হয়ে যেত ঘাসফুল শিবির কিন্তু এখানেই দলের নাম তৃণমূল আর নেত্রীর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আগুন পাখির মতো উত্থান হল তৃণমূলের, বামেদের সন্ত্রাস আর দুর্নীতি চোখে আঙুল দিয়ে বাংলার মানুষকে দেখিয়ে দিলেন মমতা। কৃষকদের জমির দাবিতে আন্দোলন তৃণমূলকে বাংলার চালিকা শক্তিতে পরিণত করছিল। ২০০৯ এর লোকসভা, ২০১০-এর পৌরসভা নির্বাচন আসতে আসতে ইঙ্গিত দিচ্ছিল ২০১১-তে কী হতে চলেছে। অবশেষে পরিবর্তন এল ২০১১তে, মাত্র ১৩ বছর বয়সী একটি দল ভারতের অন্যতম শক্তিশালী দলকে হারিয়ে ক্ষমতায় চলে এল। এই সময়ের মধ্যে বিপুলভাবে জাতীয় রাজনীতির পট পরিবর্তন হয়েছে। জোট রাজনীতির দিক থেকে ভারত একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ক্ষমতায়নের দিকে এগিয়েছে, মন্দির-মসজিদ, দেশ ভক্তি ফের অ্যাজেন্ডা হয়ে রাজনীতির। মমতা শক্তি বাড়িয়ে গিয়েছেন, জাতীয় রাজনীতিতে একক শক্তি হিসেবে, তাঁর দল তৃতীয় বৃহত্তম। ২০১৬ এর বিধানসভা নির্বাচন স্বচ্ছন্দে জিতে গেল তৃণমূল।


তারপর ২০২১, ২ রা মে- সংখ্যাতত্ত্বের নিরিখে বলা যায়, তৃণমূল এমন জয় আগে দেখেনি।
তার আগে টাইম মেশিন চাপতে হয়। অন্তত নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলায় সেভাবে কোনদিনই বিরোধী দলকে আসন দেয়নি বাংলার জনগণ অর্থাৎ সংখ্যাতত্ত্বের হিসেবে খুব শক্তিশালী বিরোধী দল তৈরি করেননি বাংলার মানুষ। ২০০৬, ২০১১, ২০১৬-এর নির্বাচনী ফল তাই প্রমান করে। যেখানে সরকারপক্ষ ডবল সেঞ্চুরি করে ফেললেও, বিরোধী দল সমষ্টিগত ভাবেও তিন অংকে পৌঁছতে পারেনি।


একটি সুশাসনের মধ্যে থাকলেও মানুষের মনস্তত্ত্ব কিন্তু প্রতিষ্ঠান বিরোধী হতে বলে তাদেরকে, ফলে একটা সরকার বিরোধী মনোভাব সবসময় কিছু মানুষের মধ্যে থাকবেই।


২০১১ সালের আগে, ২০০৮ থেকে এরাজ্য বামফ্রন্টের রক্তক্ষয় শুরু হয়েছিল। ২০১৬তে কংগ্রেসের সাথে জোট, এই ক্ষয়ের কফিনে শেষ পেরেক গাঁথে। অন্যদিকে ২০১৪তে দেশে ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। রাজ্যের তৃণমূল বিরুদ্ধমত পোষণকারী জনগন বিভ্রান্ত।তখন থেকেই ভাল মাত্রায় রাজ্য সরকার বিরোধী ভোট যেতে শুরু করল বিজেপিতে, সেই সঙ্গে কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকার সুবিধার্থে আরও কিছু ভোট এবং তাঁদের নিজেদের কিছু স্বল্প সংখ্যক পকেট ভোট যোগ হল। এই হল বাংলায় বিজেপির মূলধন।১৬তে ডান-বাম জোট হওয়া, বিজেপির ভোট বৃদ্ধিকে আরও গতি দিল। মানুষ বিজেপিকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রধান দল ভাবতে শুরু করল।বিজেপিও আস্তে আস্তে সম্ভাবনা দেখে জাঁকিয়ে বসল বাংলায়।


এবার ১৯ এর ভোট, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলার রাজনীতি বদলে দেওয়া একটি ভোট এটি। দেশের ধর্মীনিরপেক্ষ ডানপন্থা ও বামপন্থার মৃত্যু হল, এ ভোটের ফল বেরোনো সঙ্গে সঙ্গে। সেই সঙ্গে আঞ্চলিক দল গুলির ভোট ব্যাঙ্ক কমতে শুরু করল। বোঝা গেল জোট রাজনীতি নয়, মানুষ একক একটি দলকে দেশের শাসনভার দিতে চায়। সেই সঙ্গে মোদী বিরোধী মুখের অভাব ও কংগ্রেসের দূর্বলতা প্রকট হয়ে চোখে পড়ে।দেশে তো বিজেপি ক্ষমতায় আসেই, সেই সঙ্গে বাংলায় বিজেপির ভোট বাড়ে, জন্মানো পরে এই প্রথম বাংলায় জাঁকিয়ে বসল বিজেপি। তাঁদের ভোট বাড়ল, আসন বাড়ল। অন্যদিকে তৃণমূলেরও ভোট বাড়ল, কিন্তু আসন কমল। বাম মুছে গেল কার্যত, রাজ্যের নিরিখে কংগ্রেসের অবস্থা নতুন করে খুব একটা খারাপ না হলেও, বাজে। এই বাম ভোট কমে যাওয়াই বিজেপিকে প্রাণ বায়ু দিল বাংলায়।
এই শুরু হল রাজ্যের পরিবর্তন, পাল্টে গেল আমাদের আসেপাশের মানুষগুলো। কেবল রাজনীতি নয়, অর্থ-সামাজিক সর্বক্ষেত্রেরই পরিবর্তন শুরু হল।


মনে আছে ২০১৮-এর ত্রিপুরা বিধানসভার ফল বেরোনোর পরের দিন, বারাসাতে পায়োনিয়ার পার্কের মাঠে বসে আছি, একটা মাইক নিয়ে একটা টোটো আর ছোট্ট একটা মিছিল যাচ্ছে, মিছিল থেকে আওয়াজ “আগার হিন্দুস্তান মে রেহেনা হোগা তো জয় শ্রীরাম ক্যাহেনা হোগা”। ওই প্রথম আমার রাজ্যের বদল আমি নিজে কানে শুনলাম। তার আগে ২০১৭-তে ঋষিবঙ্কিমচন্দ্র কলেজ থেকে তৃতীয়বর্ষের ফাইনাল প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়েছি, দেখলাম মিছিল হচ্ছে তরওয়াল নিয়ে, রামনবমীর মিছিল। বুঝলাম আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছে বাংলা। বাংলা তার চিরাচরিত ধর্মনিরপেক্ষতা হারিয়ে ফেলছিল, নিজে প্রতিদিন একটু একটু করে দেখছিলাম। বাংলায় যে রাম রহিমের শান্তিপূর্ণ বন্ধুত্বের সহাবস্থান ছিল, তা ক্রমেই হারিয়ে গেল। বিজেপি হিন্দুদের একটা অংশকে বিশ্বাস করিয়ে ফেলল যে হিন্দুরা এ রাজ্যে বিপদজনক অবস্থায় রয়েছে।হিংসার বীজ বপন হয়েগেল। সেই অংশগুলো হল তথাকথিত পিছিয়ে পড়া মানুষ বসবাস করেন তেমন এলাকা, লক্ষ্য করে দেখবেন সেই জায়গায়গুলোতেই বিজেপি এবারও ভাল ফল করেছে।


২০১৯-এর ভোটের আগে দেশে সিনেমা তৈরি হল রাজনীতি নিয়ে, বিজেপি সরকারের স্তুতি করে উরি, নমো আবার কংগ্রেসকে ধুলিস্যাৎ করতে দ্যি অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার, তাসখন্দ ফাইল। এই প্রথম সিনেমায় রাজনীতিকরণ হল, কারোর চোখেও পড়ল না। নতুন করে ইতিহাস লেখা শুরু হল, মিথ্যে দিয়ে সত্যিকে চাপা দেওয়া অবশ্য ১৪তে বিজেপির কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই তারা চালাচ্ছিল।নিত্যদিন নতুন নতুন ইতিহাস লেখা হল ভারতের বুকে।
১৯-এ এ রাজ্যে এত ভাল ফল, ওদের লোভ বাড়িয়ে দিল। এরপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাপালো বিজেপি, অবশ্য সামগ্রিক পরিস্থিতি তৈরি ছিলই। বামেরা বিরোধী হিসেবে চরম ভাবে ব্যর্থ। ফলে তৃণমূল বিরুদ্ধমনস্ক মানুষের সবেধন নীলমণি হল বিজেপি। এটাই হাতিয়ার করল তারা। দিন কিভাবে বদলালো একটু নিজেদের প্রশ্ন করলেই জানবেন, এ রাজ্যে বিগত আট বছরে কটা হনুমান মন্দির বেড়েছে হিসেবে আছে, রামনবমী, গণেশ চতুর্থী বাংলায় এই ভাবে পালন হচ্ছে, আগে দেখেছেন কখনও? আপনার উত্তর বলে দেবে পট পরিবর্তনের কথা।


২০১৯ এরপর বিজেপি এমন একটা প্রচার শুরু করল যেন বাংলায় তাঁদের ক্ষমতায় আসা, কেবল সময়ের অপেক্ষা।


এখানেই মমতা ম্যাজিক। তৃণমূল কিন্তু এরমধ্যেও প্রতি নির্বাচনে তাদের ভোট বাড়িয়ে গিয়েছে। আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই একটি অপ্রতিরোধ্য মুখ, তাঁর জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। এখানেই বিজেপির বাংলা জয় অধরা থেকে গেল। ভাগ্যিস বিজেপির একটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নেই, নয়ত কী হত কে জানে? ওরা বাংলায় ক্ষমতায় আসলে বাংলার অখণ্ডতা, বাংলার নির্যাস, সব শেষ হয়ে যেত। কারণ ওরা সব সময় বাংলার পরিপন্থী। সামান্য সভাসমিতি থেকে শুরু করে প্রার্থী তালিকা, কোনটাই তারা বাংলা ভাষায় করতে পারেন না। এ জিনিস বাংলা বিদ্বেষ ছাড়া আর কী!
সেখানেই উলোট পুরাণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের, তাঁর সবটাই বাংলা ঘিরে। এই বাংলাকে তিনি দুহাতে আগলে রেখেছেন, বাংলাও তাই করল।


মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়ের চারটি স্তম্ভ। এক তাঁর নিজের অগ্নিকন্যা, স্ট্রিট ফাইটার এবং সৎ ইমেজ, যা অপ্রতিরোধ্য। যাকে ব্যবহার করেই ‘দিদি কে বল’, ‘বাংলার গর্ব মমতা’ ও ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’ প্রচার অভিযান দাঁড়িয়েছিল। দুই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়ন ও জনহিতৈষী প্রকল্প, মূলত কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্যসাথির মতো প্রকল্পগুলো। যা এ রাজ্যের মহিলা ভোটকে টেনে নিয়ে আসে তৃণমূলের দিকে। এই দুই স্তম্ভ, নিজেদের মেয়েকে বাঁচাতে হবে এবং মহিলাদেরই তাঁকে রক্ষা করতে হবে; তৃণমূলকে বাড়তি অক্সিজেন দেয়।
তিন বলতে হয় দলবদলকে, নেতা যত ছেড়ে গিয়েছে কর্মীরা তত সুসংবদ্ধ হয়েছে। ঐ ঘরের মেয়েকে বাঁচানোর মতো নেত্রীকে বাঁচানো, দিদিকে বাঁচানোর আবেগ কাজ করেছে।”দেখি আমরা কী পারি” কর্মীদের এই মনোভাব দলকে দৃঢ় করেছে।


চার হল প্রচার, একুশের ভোট বাংলার রাজনীতির কর্পোরেটাইজেশান করেছে। করোনা কিছু প্রভাব ফেলতে পারেনি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যানে মানুষের ঘরে ঘরে বিছানা পর্যন্ত পৌঁছেছে প্রচার। এই চারটি স্তম্ভের পরেও সবচেয়ে বড় স্তম্ভ হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ, ২৯৪ টি কেন্দ্রে দিদিই প্রার্থী! এটাই যথেষ্ট।


একটা দল দশ বছর ক্ষমতায়, এত কুৎসা-অভিযোগ, প্রতিষ্ঠান বিরোধী মনোভাব থাকা সত্ত্বেও সে প্রতি নির্বাচনে ভোট বাড়াচ্ছে। এটা সত্যিই প্রশংসনীয়। আমরা জানি সরকারি কর্মীরা সরকারের উপর ক্ষিপ্ত হয়, নির্দিষ্ট কারণ না থাকলেও তারা ক্ষিপ্ত হন। এর নেপথ্যে থাকে আমাদের চির অসন্তুষ্টির মনোভাব। যার প্রতিফলন ঘটে ভোট বাক্সে পোস্টাল ব্যালটে, কিন্তু এবারে সেখানেও ব্যাতিক্রম।


বিজেপির তরফ থেকে লাগাতার করা কুৎসা, হুমকি, ধমকি, ব্যক্তি আক্রমণ তৃণমূলকে যে বাড়তি অক্সিজেন দিয়েছে, তা অস্বীকার করা যায় না।


বিজেপি নেতারা ‘বাংলার জন্য কী ভাবছেন’ বলার থেকে পিসি ভাইপো নিয়ে বলেছেন বেশি যা হিতে বিপরীত হয়েছে। ওরা যত আক্রমণ করেছে বাংলা ও বাঙালি তত দানা বেঁধেছে এক লক্ষ্যে। সিবিআই ইডিকে তোতাপাখির মতো ব্যবহার করাও মানুষ ভাল ভাবে গ্রহণ করেনি।
এই নির্বাচনী সন্ধিক্ষণে সবচেয়ে লাভ হয়েছে তৃণমূলের, কারণ তৃণমূল তাঁদের আগামীর নেতা পেয়ে গিয়েছে, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকেও সবচেয়ে বেশি আক্রমণ করা হয়েছে, উল্টোদিকে তিনি প্রতিটি বিধানসভায় গিয়ে গিয়ে প্রচার করে এসেছেন। যা শাপে বর হয়েছে, অভিষেকেরও সার্বিক গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। তাঁকে শুনতে ভিড় বেড়েছে অর্থাৎ তৃণমূলের পরবর্তী প্রজন্মের নেতৃত্ব তৈরি। তাই একুশের নির্বাচন অভিষেকের নির্বাচন হয়েই থাকবে। মমতার সেনাপতি অভিষেক, ঠান্ডা মাথার সেনাপতি যেকোন লড়াই জেতার অন্যতম ফ্যাক্টর। ওঁর বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিজেপির পাড়ার নেতা কেউই বাদ রাখেনি আক্রমণ করতে। কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত প্রচার, বক্তব্য এক অন্য অভিষেককেই চিনিয়েছে এবার।


মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার দল খুব সুন্দর করে বাংলার মানুষের সামনে বিজেপির বাংলা ও বাঙালি বিদ্বেষী রূপটি তুলে ধরতে পেরেছে। এন আর সি তো ছিলই, সেই সঙ্গে বহিরাগত তত্ত্ব আগুনে ঘি ফেলেছিল। শিল্পী, সুশীলসমাজ বিজেপির বিরুদ্ধে নামে যা বিজেপি বিরোধী জনমত তৈরি করে। আদতে বিজেপির কোন হাওয়াই ছিল না, ১৯-এ ১৮ আসন জেতা দুর্ঘটনা বই আর কিছুই না। তবে সে সময় যে কিছুটা প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়াও ছিল, তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু ২১-এ এক্কেবারে আলাদা ছবি। যে বামেরা বিরোধীর ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়ে বিজেপির সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। তারাই একুশে কংগ্রেসের ও আব্বাসের হাত ধরায়, মানুষ আরও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। ফলে অধিকাংশ বিজেপি বিরোধী ভোট তৃণমূলের দিকে চলে আসে।
বিজেপি বাংলায় জয় পেলে বাংলা শেষ হয়ে যেত, এক দুর্গা পুজো নিয়েই দেখলেন তো কি দড়ি টানাটানি হল। অথচ ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনায় এরাই কোটি কোটি টাকা খরচ করে পুজো করে গতবার কত কিছু করেছিল। আর এবার দুগ্গাও বিজেপির কাছে কেমন যেন ভাগের মা।এমন হাজারটা উদাহরণ আছে কিন্তু তা আজ নিষ্প্রয়োজন।


মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া, কর্মীদের বাড়তি উন্মাদনা দিয়েছে।বিশ্বাসঘাতকেরা যখন আজকের পলাশী ছেড়ে পালাচ্ছিল, তখন মমতা কেমন যেন সিরাজ হয়ে উঠেছেন। আবার কখনও তিনি হয়ে উঠেছেন সুভাষ। কিন্তু এযুগে অনেক আবিদ হাসান, অনেক মিরমদন, অনেক মোহনলাল, অনেক হাবিবুরেরাও ছিলেন।


আমি যদি নন্দীগ্রাম থেকে দাঁড়াই কেমন হয়, এই একটি বাক্যই, বাংলার ভোটের শেষ কথা বলে দেয়। নন্দীগ্রাম এপিসেন্টার হয়ে ওঠে একুশের ভোটে। হয়ত সিধান্তটা আত্মঘাতি ছিল, কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোথাও যেন জহর ব্রতের মতো নিজে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে, তাঁর দল ও বাংলাকে রক্ষা করলেন।


শুনছেন তো বিজেপি নেতামন্ত্রীদের উক্তি, কেউ বলে উত্তরবঙ্গ আলাদা চাই, কেউ রাঢ় বাংলা চায়। না জিততেই এই!
তাই ভাবি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় না থাকলে হয়ত বাংলা খণ্ডে খণ্ডে ভেঙে যেত। আজ হয়ত উৎসবও বিভক্ত হয়ে যেত। আমার বাংলা রবি-নজরুল-বিবেক-সুভাষের বাংলা, ভাল থাক সে। নাহুমসের কেক খাব, জাকারিয়ায় কাবাব আর বাড়িতে পায়েস খাব, আমার বাংলাটাকে এমনই রাখুন না। ইমরানের মা সিমুইটা বড্ড ভাল করে, ঈদে যেন প্রতিবার খেতে পারি। এখনও এই কথাগুলো যে লিখতে পারছি, তার জন্য বাংলার মানুষকে ধন্যবাদ। আপনাদের জনাদেশকে, আপনাদেরকে প্রণাম করি।
আপনাদের জনাদেশ এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গভঙ্গের সময়ের রবি ঠাকুরের মতোই ফের বাংলার সম্প্রতি রক্ষা করল। বাংলার মানুষ লড়ল মুক্তি যুদ্ধের মতো করে। আজ সারা ভারতে নানান রাজ্যে তৃণমূলের বিস্তার। মোদী শাহদের আটকে দিয়ে মমতাই দেশের প্রধান বিরোধী মুখ। তৃণমূল এখন দেশে ক্রমবর্ধমান! দেশ বাঙালি চালাবে, এই আশায় বাংলা বুক বাঁধছে। বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Mamata Banerjee, #tmc, #Trinamool Congress, #TMC foundation day, #Street fighter, #Politician

আরো দেখুন