আর্তনাদ করছে গ্রামীণ ভারত, মোদী আমলে সংকটের মুখে গ্রামীণ জীবন-জীবিকা
মোদী আমলে আর্তনাদ করছে গ্রাম। ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে দেশের বুনিয়াদ গ্রামীণ জীবন- জীবিকা। গ্রাম হল দেশের বুনিয়াদ, সেই গ্রামই এখন খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে। সৌজন্য বিজেপির সরকারের জনবিরোধীনীতি। গ্রামীণ অর্থনীতি একেবারেই ভেঙে গিয়েছে। গ্রামীণ মানুষের আয়ের অন্যতম উৎস ছিল মনরেগা প্রকল্প। অর্থাৎ চলতি কথায় ১০০ দিনের কাজ। কিন্তু বিজেপি সরকার সাধারণ মানুষের সেই আয়ের উপায়টুকু নিয়ে কার্যত রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপূরণে ব্যস্ত।
কাজ না থাকায়, ১০০ দিনের কাজের আওতাধীন ৩.১ কোটি পরিবার শুধু মে মাসেই কাজ খুঁজছে। যা অশনি সংকেত। বিপদের চরমতম সীমায় দাঁড়িয়ে গ্রামীণ ভারত। FMCG পণ্যের বিক্রি তীব্র হারে হ্রাস পাচ্ছে, সমস্ত লক্ষণই বলে দিচ্ছে গ্রামীণ জীবিকা সংকটাপন্ন।
ভাবুন একটি কাজের দৈনিক মজুরি, অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য সংবিধিবদ্ধ ন্যূনতম মজুরি এবং বাজার চলতি মজুরি, উভয়ের চেয়েই কম। কাজটি একবারে প্রায় ১০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। কাজের মজুরি পেতে অর্থাৎ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা হতে দুই সপ্তাহের বেশি সময় লেগে যেতে পারে। গ্রীষ্মের অসহ্যকর গরমে একজনকে দিনে প্রায় ছয় থেকে আট ঘন্টা কাজ করতে হয়। রাস্তা তৈরি করা বা জলাধার খনন করা, কোদাল চালানো ইত্যাদি কষ্টকর কাজ। এতকিছুর পরেও হাজার হাজার মানুষ এই ধরনের কাজের লাইন দিচ্ছেন। যা স্পষ্ট ইঙ্গিত করে অবস্থা ভাল নয়। বলে দেয় সংকট আসন্ন।
প্রসঙ্গত, ২০০৬ সালে তদানিন্তন কেন্দ্র সরকার অর্থাৎ প্রথম ইউপিএ সরকার গ্রামীণ মানুষকে সামাজিক সুরক্ষা দিতে মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি স্কিম বা MGNREGS চালু করে। যা গ্রামীণ পরিবারগুলিকে ১০০ দিনের কাজের নিশ্চিত আয় দেয়। সেই প্রকল্পেই চলতি বছরের মে মাসে এক নজির সৃষ্টি হয়েছে৷ মে মাসে ১০০ দিনের কাজের দাবি করা পরিবারের সংখ্যা ৩.০৭ কোটিতে এসে ঠেকেছে। যা এই প্রকল্পের সূচনার পর থেকে অদ্যাবধি সর্বোচ্চ। অতিমারি পূর্ববর্তী বছরগুলিতে অর্থাৎ ২০১৫-২০১৯ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের গড় কাজের চাহিদার তুলনায় গত মাসে পরিবারগুলির কাজের চাহিদা ৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অদক্ষ পুরুষ কর্মীদের গড় দৈনিক মজুরি ৩৩৭ টাকা, সেখানে ১০০ দিনের কাজে নিযুক্তদের দৈনিক মজুরি ২০৯ টাকা। যা গ্রামীণ ভারতে তীব্র দৈনদশার সাক্ষ্য বহন করেন। পর্যাপ্ত কাজ নেই, মানুষের হাতে খাবার কেনার টাকা নেই।
গ্রামীণ মজুরিতে মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব পড়েছে। ২০২২-এর জানুয়ারী থেকে তীব্র হচ্ছে সংকট। গ্রামীণ এলাকায় বিপুল কাজের চাহিদা রয়েছে কিন্তু জোগান তলানিতে। সাধারণত ১০০ দিনের কাজে পুরুষদের তুলনায় মহিলারাই বেশি কাজ করেন। তবে এখন পুরুষরাও কাজের সন্ধানে ১০০ দিনের কাজে লাইন দিচ্ছেন।
বেঙ্গালুরুর আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক রাজেন্দ্র নারায়ণন ১০০ দিনের কাজ নিয়ে পর্যবেক্ষণ চালিয়েছেন। তাঁর মতে, প্রতি বছর এপ্রিল-মে ১০০ দিনের কাজের চাহিদার সর্বোচ্চ থাকে। এবার যা পূর্বের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। কাজ চেয়েছেন বলে যে ৩.০৭ কোটি পরিবারের দাবি করা হচ্ছে তা আদপে অবমূল্যায়ন। সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি। যে সকল মানুষ বা পরিবারের ১০০ দিনের কাজ চেয়েছেন তাদের মধ্যে ৩২-৩৪ শতাংশ নথিভুক্ত করা হয়েছে। তাতেই ৩.১ কোটি পরিবার!
এছাড়াও অন্যান্য সূচকগুলি যা গ্রামীণ আয় এবং চাহিদা হ্রাসের দিকে নির্দেশ করে, তাও সিঁদুরে মেঘ দেখাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, গ্রামীণ ভারত শহুরে ভারতের থেকে বেশি টু-হুইলার কেনে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে, ২০২২-এর এপ্রিল-মে যে সংখ্যক নতুন দু-চাকা গাড়ি নথিভুক্ত, তা ২০১৮ সালের ওই একই সময়ের বিক্রির তুলনায় ২১ শতাংশ কম।
যদিও কৃষি উপার্জনের উপর নির্ভরশীল গ্রামীণ পরিবারগুলির অবস্থা আরও রুগ্ন হয়ে উঠছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে কৃষির খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিকূল জলবায়ুর কারণে শস্য এবং পচনশীল পণ্যের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। খারিফ ফসল চাষও লাভের মুখ দেখেনি। গ্রামীণ আয় কমে যাওয়ায় প্রভাব FMCG পণ্যে বিক্রয় উপর পড়েছে। বিক্রির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। ভোজ্য তেল, আটা, সাবান, শ্যাম্পুর মতো জিনিসের বিক্রি কমাই বলে দেয় গ্রামের মানুষের হাতে টাকা নেই। তাদের ক্রয় ক্ষমতার নাগাল পেরিয়ে গিয়েছে।
গ্রামীণ বাজারে আরও কঠিন সংকট আসতে চলেছে যা খুব শীঘ্রই শহরেও প্রতিধ্বনিত হতে চলেছে। গ্রামীণ বাজারগুলিতে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে বিক্রয়ের পরিমাণে ৫.৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। শহরাঞ্চলের বাজারে ৩.২ শতাংশ বিক্রি সংকুচিত হয়েছে। স্পষ্ট মন্দার ইঙ্গিত দেখা দিচ্ছে। গ্রামীণ অঞ্চলে দরিদ্র এবং অতিদরিদ্র পরিবারগুলো একবারেই বিপদসীমার উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সম্পদের মালিকানা হ্রাস, ক্রমবর্ধমান ঋণ এবং জমির মতো উৎপাদনশীল সম্পদে বিনিয়োগের পরিমাণ কমছে, অর্থাৎ আঁধারে ডুবছে গ্রামীণ ভারত।