দেশ বিভাগে ফিরে যান

হালের জাতীয়তাবাদ আদপে ধর্মীয় বিভাজন ঘটাচ্ছে, মত ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপারের

January 16, 2023 | 2 min read

মোদী আমলে বারে বারে ইতিহাসকে বিকৃত করার অভিযোগ তুলেছেন বিরোধীরা। এবার একই অভিযোগে মোদী সরকার ও বিজেপিকে কাঠগড়ায় তুললেন ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার। শনিবার দিল্লির ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে সি ডি দেশমুখ স্মারক বক্তৃতায় রোমিলা থাপারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বিষয়বস্তু ছিল ‘আমাদের ইতিহাস, তাদের ইতিহাস, কাদের ইতিহাস’। ইতিহাসবিদ রোমিলা এদিন ইউরোপের ইতিহাসবিদ এরিক হবসবমের উদ্ধৃত মাধ্যমে ইতিহাসের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের সম্পর্ক আর আফিমের সঙ্গে হেরোইন আসক্তির সম্পর্কের তুলনা টানেন।

যদিও এই অনুষ্ঠান নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। দিল্লির বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র সমাজমাধ্যমে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, দিল্লি পুলিশকে উল্লেখ করে অভিযোগ করেন, সি ডি দেশমুখ স্মারক বক্তৃতার লক্ষ্যও হল বিদ্বেষপূর্ণ মিথ্যা প্রচার। থাপারের বক্তৃতা নাকি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করবে বলেও অভিযোগ করেন বিজেপি নেতা। সমাজমাধ্যমে ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার কর্তৃপক্ষের কাছে ওই বক্তৃতা বাতিল করার দাবিও ওঠে। কপিল অভিযোগ রোমিলা থাপারের মতো ব্যক্তিরা নাকি মিথ্যা ইতিহাস লেখেন, ভুয়ো তথ্য দিয়ে হিন্দুদের গণহত্যার পক্ষে যুক্তি দেন।

অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে শনিবার সন্ধ্যায় বাড়তি নিরাপত্তায় অনুষ্ঠানটি হয়। ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের সদস্য এবং আমন্ত্রিত ছাড়া কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তাতেই হাউসফুল ছিল প্রেক্ষাগৃহ ৯১ বছরের রোমিলা বক্তব্যের মাধ্যমে অভিযোগকারীদেরই জবাব দিয়েছেন। ইতিহাসবিদ আর রূপকথাকে ইতিহাস দাবি করে প্রচার চালানো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে ফারাক রয়েছে, তাও মনে করিয়ে দিয়েছেন রোমিলা। রোমিলা বলেন, নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণভিত্তিক, প্রশিক্ষিত ইতিহাসবিদদের লেখা ইতিহাস পড়ুয়াদের পড়ানোটা দরকার। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় যে জাতীয়তাবাদ গোটা দেশকে জোট বিদ্ধ করেছিল, তার সঙ্গে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিকারী জাতীয়তাবাদের বিস্তর ফারাক রয়েছে। তিনি বলেন, স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ জন্ম নিয়েছিল। হিন্দু, মুসলমান; দুই ধর্মের জাতীয়তাবাদ দেশ ভাগ করেছে। মুসলিমদের জন্য পাকিস্তান তৈরি হয়েছে। হিন্দুরা হিন্দুরাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এটাই ঔপনিবেশিক পরিকল্পনাই সফল করে দিচ্ছে। বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদীদের লাভ জিহাদ তত্ত্ব নিয়েও সরব হয়েছে থাপার। তাঁর মতে, মোঘলদের সঙ্গে রাজপুতদের বিয়ে হয়েছিল। কোনও শাসকের স্মৃতিকথায় বা আত্মজীবনীতে উল্লেখ নেই, যে এই সব বিয়ে বল প্রয়োগ করে করা হয়েছিল।​

রোমিলা থাপার প্রশ্ন তুললেন, হলদিঘাটে মোঘলদের সঙ্গে রাজপুতদের যুদ্ধে আকবরের সেনার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাজা মান সিংহ। মহারাণা প্রতাপের সেনাবাহিনীতে আফগান যোদ্ধাদের নেতৃত্বে ছিলেন শের শাহ সুরির উত্তরসুরি হাকিম খান সুরি। তা হলে মোঘল বনাম রাজপুতদের যুদ্ধকে কীভাবে হিন্দু-মুসলমানের লড়াই হল?

মোদী থেকে শাহ বারবার জাতীয়তাবাদের দাবি তুলে নতুন করে ইতিহাস লেখার প্রয়োজনের কথা বলছেন। মোঘলরা পেয়েছেন আর চোল-গুপ্ত- মৌর্য রাজারা উপেক্ষিত থেকেছেন, অভিযোগ করে প্রাচীন ভারতের ‘গৌরবময় অতীত’ তুলে আনতে বলছেন তারা। আদপে মুছে ফেলা হচ্ছে ইসলামী যুগের ইতিহাস। ইতিহাসের কি হিন্দু-মুসলমান হয়? ইতিহাস তো ইতিহাসই। মোদী-শাহরা মোঘলদের আক্রমণকারী বলে আখ্যায়িত করেন। মোঘল, সুলতান শাসকদের বিরুদ্ধে দেশের হিন্দু সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধ্বংস করার অভিযোগ করেন। বিরোধীরা অভিযোগ করেন দেশের শাসক দলের এই উস্কানিতেই অযোধ্যার পরে কাশী, মথুরায় একের পর এক মসজিদের জায়গায় মন্দির ছিল বলে সেখানে পুজোর দাবি উঠছে। কুতুব মিনার চত্বরে পুজো করার অনুমতি চেয়ে দিল্লি আদালতে মামলা দায়ের হয়েছে। রোমিলা বলেছেন, চতুর্দশ শতাব্দীতে বাজ পড়ে কুতুব মিনার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মেরামতি করতে গিয়ে হিন্দু রাজমিস্ত্রিরা মিনারের গায়ে হিন্দিতে ও ভুল সংস্কৃতে দেবতা বিশ্বকর্মা ও গণেশের কথা খোদাই করেছিলেন। এত বছর পরে সেই খোদাই করা অক্ষর দেখিয়ে হিন্দু সংগঠন বলছে, ওখানে আগে মন্দির ছিল। কুতুব মিনার নাকি বিষ্ণু স্তম্ভ। ধর্মে আফিম খাইয়ে যে দেশকে অন্ধ করে রাখা হচ্ছে, সে কথাই কার্যত বলে গিয়েছে প্রবীণ ইতিহাস বিদ।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Modi, #Narendra Modi, #Amit shah, #Nationalism, #Romila Thapar, #religious division

আরো দেখুন