পুজো স্পেশাল বিভাগে ফিরে যান

মঙ্গলাপোতা নাম – তরবারি পুজো, এই রাজবাড়ির পুজো এক ইতিহাসের জীবন্ত দলিল

October 15, 2023 | 3 min read

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার অন্যতম প্রাচীন পুজো মঙ্গলাপোতা রাজবাড়ির দুর্গাপুজো। এই পুজোকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে আছে নানা কিংবদন্তী ও ইতিহাস। ৪০০ বছরেরও বেশি পুরাতন মঙ্গলাপোতার দুর্গাপুজো। এই পুজোর অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হল দুর্গা পুজোর সম প্রাচীন রীতি অনুসারে ৪টি তরবারির পুজো। জিতাষ্টমীর দিন প্রথম তরবারির পুজো করা হয়, দ্বিতীয় তরবারির পুজো মহালয়ার দিন, তৃতীয়টি ষষ্ঠীর দিন আর চতুর্থটির পুজো হয় সপ্তমীর দিন। সপ্তমীতে যে তরবারির পুজো হয় সেটি বিশালাকার।

জনশ্রুতি, এই তরবারি দিয়েই বহুকাল আগে এখানে সামসের জং বাহাদুর বিষ্ণুপুর মল্লরাজ খয়ের মল্লকে পরাজিত করে মঙ্গলাপোতা রাজবাড়ি ও সর্বমঙ্গলার ঘট উদ্ধার করেন। শোনা যায়, তৎকালীন উড়িষ্যা রাজ্যের বীরযোদ্ধা সামসের জং বাহাদুর মা কালীর সাধনা করে এই তরবারি লাভ করেন। আর এই তরবারি দিয়েই খয়ের মল্লকে পরাজিত করেন। নাকি এই তরবারি মন্ত্রপূত। বর্তমানে এই তরবারি সহ আর তিনটি তরবারি মঙ্গলাপোতা রাজবাড়ির কুলদেবতা রাধাকৃষ্ণ জিউ-এর দেউল সংরক্ষিত আছে। রাধাকৃষ্ণ, লক্ষ্মীনারায়ণ, সর্বমঙ্গলা, দুর্গা ছাড়াও এখানে এই তরবারিগুলিরও প্রতিদিন পুজো হয়ে থাকে। দুর্গাপুজোর সময় এখান থেকে এই গুলি নিয়ে যাওয়া হয় মূল মণ্ডপে। কাছেই মূল মণ্ডপের বামপাশে বিরাট এক উইঢিপি আছে সেখানে রাখা হয় এবং পুজো করা হয়।

ভক্তদের বিশ্বাস অনুযায়ী এই তরবারিকে মা কালী জ্ঞানে পুজো করা হয়। এখানে আসলে কালী মা। দুর্গাপূজার সপ্তমীর দিন এবং পরবর্তী অমাবস্যায় শ্রী শ্রী শ্যামাপুজোর দিন এই তরবারিটিতে দু’মিটার করে চারমিটার লাল শালু কাপড় জড়ানো হয়। তবে অবাক করা বিষয়টি হল পুরাতন শালুকাপড়টি ফেলা হয় না। তার উপরেই এই লাল শালু জড়ানো হয়। ফলে তরবারির কাঠামো মোটা হয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু হয় না।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই মঙ্গলাপোতা রাজবাড়ি আসলে ছিল রাজাদের আমোদ-প্রমোদের বাগানবাড়ি। যা বগড়ীর রাজা ছত্রসিংহ নির্মাণ করেছিলেন। প্রচলন করেছিলেন দুর্গাপুজোর। এই রাজবাড়ির দুর্গাপুজো আনুমানিক ২৩৩ বছরের পুরোনো। আবার কথিত আছে যে এই পুজোর প্রচলন করেছিলেন রাজা ছত্রসিংহ বাহাদুর। তাঁর রাজত্বকাল আনুমানিক ১৭৭৯-১৮২৫ খৃষ্টাব্দ। তবে এ নিয়ে মতবিরোধ আছে। কোন‌ও কোন‌ও ঐতিহাসিকদের মতেমঙ্গলাপোতার এই রাজবংশের প্রথম রাজা ছিলেন রাজা গজপতি সিংহ। যাঁর রাজত্বকাল ছিল ১৩৯১-১৪২০ খ্রিস্টাব্দ। এই বংশের নবম রাজা যিনি ছিলেন তাঁর নামও রাজা ছত্রসিংহ। এই ছত্রসিংহের রাজত্বকাল ছিল ইং-১৬২২-১৬৪৩ খ্রিস্টাব্দ। ইনিও মঙ্গলাপোতাতে দেবী দুর্গার পুজোর সূচনা করতে পারেন। যদি সেটা হয় তাহলে এই পুজোর বয়স হবে আনুমানিক ৪০০ বছরেরও বেশি।

জানা গিয়েছে, গড়বেতার সর্বমঙ্গলার আসল ঘটটি বলপূর্বক রাজা ছত্রসিংহ নিয়ে এসেছিলেন। সেই ঘট এই জায়গায় পোঁতা আছে বলেই এখানকার নাম হয়েছে মঙ্গলাপোতা। কিছুকাল বিষ্ণুপুরের মল্লরাজ খয়েরমল্ল দেবী সর্বমঙ্গলার এই ঘট নিয়ে চলে যান। সামসের জং বাহাদুর রাজা ছত্রসিংহের পাশে দাঁড়িয়ে খয়ের মলকে পরাজিত করে এই ঘট আবার উদ্ধার করে নিয়ে চলে আসেন।

পুজোর ১৫ দিন আগে থেকেই এখানে দেবীর ঘট প্রতিষ্ঠা করা হয়। জীতাষ্টমী, মহালয়া এবং ষষ্ঠী থেকে হোম, যাগযজ্ঞ এবং চণ্ডীপাঠ শুরু হয়ে যায়। তবে দেবী বিগ্রহ প্রতি বছরই নতুন করে তৈরি করা হয়। ঐতিহ্য অনুসারে এখন‌ও সপ্তমী, সন্ধিপুজো, নিশি আর ছাগ বলি হয়। একসময় এখানে মোষ বলিও হত।

সময়ের সাথে সাথে কিছুটা জৌলুস হারালেও সুপ্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারে এই দেবীর পুজো হয়। এই পুজোতে মণ্ডপ স্থায়ী। বেদি তৈরি পঞ্চমুণ্ড দিয়ে। অতীতে পুজোমণ্ডপের দেওয়াল ছিল মাটির, ছাউনি টালি আর টিনের। দরজা কাঠের। বারান্দায় রয়েছে ৬টি প্রকান্ড থাম। এক‌ইরকম ৪টি থাম রয়েছে বাড়ির ভিতরেও। এখানে একচালায় দেবীর পুজো হয়। বর্তমানে মণ্ডপের সামনে তৈরি করা হয়েছে আটচালা।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#durga puja, #west midnapore, #Durga Puja 2023, #Mangalapota Rajbari

আরো দেখুন