রাস উত্সবে শাক্ত ও বৈষ্ণব মতের মহামিলনক্ষেত্র হয়ে ওঠে দাঁইহাট
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: রাস উত্সবকে ঘিরে শাক্ত ও বৈষ্ণব মতের মহামিলনক্ষেত্র হয়ে ওঠে দাঁইহাটের রাস উত্সব৷ রাসে কোথাও পূজিত হন মহাপ্রভু, রাধাকৃষ্ণ৷ কোথাও আবার দুর্গা-কালী-জগদ্ধাত্রী৷ শতাব্দী প্রাচীন এই রাস উত্সবই আজ দাঁইহাটের ঐতিহ্য , পরিচিতি৷ শুক্রবার দাঁইহাটে রক্তদান শিবিরের মাধ্যমে রাস উৎসবের সূচনা হয়েছে।
রাস উৎসবের মধ্যেই দাঁইহাট শহরের ব্যতিক্রমী বড় মা কালীর পুজোকে ঘিরে মাতোয়ারা শহরের বাসিন্দারা। তবে দক্ষিণা কালী হিসাবে পূজিত প্রাচীন এই বড় মা কালীকে অমাবস্যার বদলে পূর্ণিমার আলোয় বৈষ্ণবমতে পুজো করা হয়। কালীপুজো সাধারণত অমাবস্যার রাতে হয়। কিন্তু ব্যতিক্রম শুধু দাঁইহাটের বড় মা কালী পুজো।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় , দাঁইহাটের রাস উত্সব প্রায় ৫০০ বছরের প্রাচীন৷ দাঁইহাটের তত্কলীন জমিদার চন্দ্র পরিবারের কোনও এক বংশধর শান্তিপুরের চকাফেরা গোস্বামীদের দ্বারা প্রভাবিত হন৷ তিনি শান্তিপুরে গোস্বামীদের কাছে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হন৷ দাঁইহাটে ফিরে তিনিই রাস উত্সবের সূচনা করেন৷ ধারাবাহিক ভাবে তা বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ তবে ইতিহাস বলছে , রাস উত্সব ৫০০ বছরের প্রাচীন হলেও প্রায় এক হাজার বছর আগে থেকেই দাঁইহাটে রাসের দিন শক্তির আরাধনা করা হত৷ জানা যায় , সে সময় দাঁইহাট ছিল ইন্দ্রাণী নদীর ব-দ্বীপ অঞ্চল৷ চারিদিক ছিল জঙ্গলাকীর্ণ৷ তখন তন্ত্র সাধকরা শক্তির উপাসনার জন্য দাঁইহাটকে বেছে নিতেন৷ জঙ্গলে ঘেরা দাঁইহাটে বসেই শক্তির সাধনা করতেন তাঁরা৷ দাঁইহাট ছিল তাঁদের জন্য সিদ্ধক্ষেত্র৷ তন্ত্রমতে রাসের দিন হল দেবদেওয়ালি তিথি৷ সে সময় তান্ত্রিকরা রাসের দিন পালন করত দেবদেওয়ালি৷ পটে নানা শাক্ত দেবদেবীর ছবি এঁকে পুজোপাঠ করা হত৷ পর দিন বাদ্যি -মশাল সহযোগে শোভাযাত্রা করে বিসর্জন দিত৷ রাস শুরু হওয়ার পরে এই দুই উত্সবের মেলবন্ধন ঘটে৷ ফলে দাঁইহাটের রাসে যেমন বৈষ্ণব মতে কৃষ্ণের পুজো দেখা যায় , তেমনই চোখে পড়ে শাক্ত মতে কালীর পুজোও৷ দাঁইহাটের বাসিন্দা ও ইতিহাসপ্রেমী অশেষ কয়াল বলেন,‘দাঁইহাটের রাসের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে বৈষ্ণব ও শাক্ত মতের মহামিলন৷ কোনও মণ্ডপে দেখা যায় শিবের পুজো হচ্ছে,কোনটায় কালীর,আবার কেউ মহাপ্রভুর পুজো করছেন৷এক সময় যা দেবদেওয়ালি ছিল, তা -ই রাসের সঙ্গে মিশে বর্তমানে দাঁইহাটের রাসের চেহারা নিয়েছে৷’প্রবীণরা মনে করেন , দাঁইহাটে যে সময় রাস শুরু হয়েছিল তখন শ্রীচৈতন্যের প্রভাব গোটা বাংলা জুড়ে৷ দাঁইহাটের উপর দিয়েই কাটোয়ায় এসে সন্ন্যাস নিয়েছিলেন মহাপ্রভু৷ তাই দাঁইহাটের রাস মহাপ্রভু দ্বারা প্রভাবিত৷ বর্তমানে ৬০টিরও বেশি ক্লাব দাঁইহাটে রাসের আয়োজন করে৷ বেশ কিছু পারিবারিক রাসও আছে৷ এর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন চন্দ্রবাড়ির রাস৷ এই চন্দ্র রাই কাটোয়ায় রাস উত্সবের সূচনা করেছিলেন ৫০০ বছর আগে৷
বড় মা কালীর পুজো কমিটির এক কর্মকর্তা অমিত মিশ্র বলেন, কোনও এক সাধকের হাত ধরেই প্রথম পুজো শুরু হয়। পরবর্তীকালে ভাস্কররা বড় মা কালীর পুজো করতেন। তারপর ভাস্করদের হাত ধরে এখন পুজো বারোয়ারি হয়ে উঠেছে। কার্তিকী পূর্ণিমাতেই আগে কালীপুজো হতো। তখন নবদ্বীপে, দাঁইহাটেও হতো। পরে কার্তিকী অমাবস্যাতে কালীপুজো হয়। যেহেতু নবদ্বীপ, দাঁইহাটে এক সময়ে বাণিজ্যের প্রধান জায়গা ছিল, তাই নবদ্বীপের অনুকরণে কার্তিকী পূর্ণিমাতেই বড় কালীর পুজো হতো। এখন সেটা রাস পূর্ণিমায় হয়। পুরানো রীতি মেনেই আমরা বড়কালীর আরাধোনা করি। এখানে বলিদান হয় না।