পৌষের লোকাচার ঘিরে কান্দির গ্রামে উন্মাদনা, আজও ঢেকিতে পিঠের জন্য চাল গুড়ো করেন মহিলারা

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: একটা সময় শীত পড়লেই গ্রামগঞ্জের বাড়ি থেকে ভেসে আসত ‘ধুপধাপ’ আওয়াজ। রাতে বিছানায় শুয়ে শোনা যেত দূর থেকে আসছে এই শব্দ। দিনভর কাজ তো চলতই, শীতের রাতে শীতপোশাক জড়িয়ে মাঝরাত পর্যন্ত ঢেঁকিতে চাল কোটার কাজ করতেন গ্রামের মেয়ে বউরা। আর সেই চালের গুঁড়ো দিয়ে পৌষ মাসের সংক্রান্তিতে তৈরি হত নানারকম পিঠে। তবে এখন সেসব একেবারেই কমে গিয়েছে।
সময়ের সঙ্গে এখন মানুষের সিংহভাগ কাজই মেশিন করে দিচ্ছে। চালের গুঁড়ো বিক্রি হচ্ছে প্যাকেটে। এছাড়াও বাড়িতে অনেকেই মিক্সিতে চালগুঁড়ো করে নেন। তবে ঢেঁকিতে গুঁড়ো করা চালের তৈরি পিঠের স্বাদ যে কোনওভাবেই অন্য কিছুতে নেই, তা মানছেন গ্রামের মহিলারা। বলছেন, ঢেঁকির চালের গুঁড়োয় তৈরি পিঠে যাঁরা খেয়েছেন, তাঁদের আর কিছু মুখে রোচা অত সহজ না।
কান্দি মহকুমার প্রত্যন্ত গ্রামে এখনও রয়েছে ঢেকিতে পাড় দিয়ে চাল গুড়ো করার রীতি। পৌষের লোকাচার ঘিরে আজও কান্দি মহকুমার প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দারা উন্মাদনায় মেতে উঠেন। গোবর দিয়ে লক্ষ্মীর পুতুল তৈরি করে পৌষ আগলানোর সঙ্গে আড়াই পাকের খড়ের বাউরি দেওয়া হয় চাষি পরিবারে। আবার পিঠে উৎসবের জন্য ঢেকিতে পাড় দিয়ে চাল গুড়ো করার রীতিও দেখা গিয়েছে। তাই মাস শেষ হওয়ার মুখে এসবের প্রস্তুতিতে মেতে উঠেছেন গ্রামের মহিলারা।
এলাকার প্রবীণরা বলেন, কয়েকদশক আগেও এলাকার বিভিন্ন গ্রামে পৌষমাস ভর বিভিন্ন রীতি রেওয়াজ চালু ছিল। যদিও ওইসব রীতির অনেকটাই আর প্রচলন নেই। তবে কয়েকটি রীতি রেওয়াজ আজও চালু রয়ে গিয়েছে। যেমন গোবরের লক্ষ্মী তৈরি, আড়াই পাকের বাউরি দেওয়ার সঙ্গে ঢেকিতে চাল কুটা।
বাসিন্দারা জানিয়েছেন, পৌষের শেষদিন বিভিন্ন গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে গোবরের লক্ষ্মী তৈরি করা হয়। তৈরি করা লক্ষ্মীগুলি বাড়ির উঠোন, তুলসি মন্দির থেকে বিভিন্ন ঘরের দরজার মুখে কয়েকটি করে রেখে দেওয়া হয়। এরপর পৌষ আগলান বাড়ির মহিলারা। মহিলারা রাতভর লক্ষ্মীর ব্রতকথা, পাঁচালি সহ বিভিন্ন ধর্মীয় গল্পে মেতে থাকেন। মাঝে মধ্যেই দেওয়া হয় উলুধ্বনি। বেজে উঠে শঙ্খ। এছাড়াও মাসের শেষদিন একটি খড় নিয়ে তৈরি করা বাউরি। এই বাউরি হল একটি খড় নিয়ে বাম হাতে আড়াই পাক দিয়ে কুণ্ডলী পাকান। এই কুণ্ডলী পাকান খড় পৌষের শেষদিন রাখা হয় রান্নাশাল সহ যেখানে খাবার সংরক্ষন করা হয়।
তবে সবচেয়ে আকর্ষণ হল ঢেকিতে পাড় দিয়ে পিঠের জন্য চালের গুড়ো তৈরি করা। যদিও সম্প্রতি অধিকাংশ বাসিন্দা হাসকিং মেশিনের মাধ্যমেই চাল গুড়ো করে থাকেন। তবে গ্রামের সচ্ছল পরিবারগুলিতে এখনও ঢেকিতে পাড় দেওয়ার রীতি রয়ে গিয়েছে। কান্দি ব্লকের রষোড়া গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা ধনঞ্জয় মণ্ডল বলেন, মেশিনের চালগুড়োয় তেমন স্বাদ থাকে না। তাই পিঠে তৈরির জন্য অনেক পরিবারের মধ্যে এখনও ঢেকি পাতার নিয়ম চালু রয়ে গিয়েছে। তাছাড়াও এর একটি ধর্মীয় কারণও আছে। অনেক পরিবারে সারাবছর না হলেও পৌষের শেষদিকে ঢেকি পাতা হয়। মাস পেরোলেই ফের ঢেকি তুলে নেওয়া হয়। প্রায় একই বক্তব্য বড়ঞা ব্লকের শ্রীহট্ট গ্রামের কার্তিক ঘোষের। তিনি বলেন, এবছর আমার বাড়িতেও ঢেকি পাতা হয়েছে। এখানে গ্রামের প্রায় অর্ধেক পরিবার চাল গুড়ো করে নিয়ে যাচ্ছেন।