বালিকা রূপে রানী রাসমণিকে দর্শন দিয়েছিলেন শেওড়াফুলির এই দেবী!
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: অনেক দিন আগের কথা। শেওড়াফুলি সেইসময় সাড়াপুলি নামেই পরিচিত ছিল। ভাগীরথীর তীরে এই সাড়াপুলিতেই প্রতিষ্ঠিত ছিল নিস্তারিণী কালী মায়ের মন্দির। জানা যায়, ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে, বাংলা ১২৩৪ সনের জ্যৈষ্ঠ মাসের কোনও এক শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শেওড়াফুলি রাজবংশের রাজা হরিশ্চন্দ্র রায়।
শোনা যায় রাজা তাঁর রাজ্যে পঞ্চমুণ্ডী আসনে শিবপত্নী দক্ষিণকালিকা শ্রীশ্রী নিস্তারিণী মাতার পাথরের মূর্তিসহ মন্দির ও সেবা প্রতিষ্ঠা করেন। এই দেবসেবা ও মন্দির পরিচালনার তত্ত্বাবধান করেন শেওড়াফুলি রাজপরিবারের সদস্যরা।
কেন রাজা হরিশ্চন্দ্র রায় এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন?
জনশ্রুতি, রাজা হরিশ্চন্দ্র ছিলেন পরম ধার্মিক, নিষ্ঠাবান ও মা কালীর ভক্ত। কিন্তু তিনি একবার স্ত্রী হত্যার দায়ে জড়িয়ে পড়েন। অনুতপ্ত ও অনুশোচনায় জর্জরিত রাজা প্রাসাদ থেকে চলে গিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে ব্যর্থ হন।
পরে ঘুরতে ঘুরতে গভীর জঙ্গলের এক গাছের তলায় রাজা আশ্রয় নেন । নিঝুম রাতে ক্লান্ত রাজা ঢলে পড়লেন ঘুমে। সেইসম। রাজা মাকালীর স্বপ্নাদেশ পেলেন যে, তিনি যেন গঙ্গাতীরে মন্দির ও দক্ষিণা কালীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। যে শিলাখণ্ডের উপর তিনি শুয়ে আছেন সেটি দিয়েই নির্মাণ করতে হবে দেবী মূর্তি। হতচকিত রাজা ঘুম থেকে উঠে দেখলেন এক অদ্ভুত কাণ্ড। তিনি যার উপর শুয়েছিলেন সেটি সত্যিই একটি শিলাখণ্ড। এরপরই রাজা ফিরে এলেন তাঁর রাজদরবারে। রাজকর্মচারীদের আদেশ দিলেন ওই জঙ্গল থেকে শিলাখণ্ডটি তুলে আনার। পরে তিনি জানতে পারলেন শিলাখণ্ডটি আসলে একখণ্ড মূল্যবান কষ্টিপাথর।
এরপরে ঘটল আরও এক আশ্চর্য ঘটনা। হঠাৎ একদিন রাজবাড়িতে এলেন এক ভাস্কর। তিনি জানালেন মা কালীর আদেশেই তিনি দেবীর মূর্তি গড়তে এসেছেন। বিস্মিত ও হতবাক রাজা তৎক্ষণাৎ মূর্তি নির্মাণের আদেশ দিলেন। যথাসময়ে সঠিক নিয়মে গড়া হল মায়ের মূর্তি। মন্দিরে স্থাপিত হল বিগ্রহটি। এরপর রাজা হরিশ্চন্দ্র মন্দিরের পশ্চিমে নির্মাণ করলেন একটি কুটির। দিনের বেশিরভাগ সময়ই তিনি কাটাতেন এই কুটিরে। শোনা যায়, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাজা এভাবেই কাটিয়েছিলেন।
এছাড়াও কথিত আছে, রাণী রাসমণি দেবী একদিন স্বপ্নে দেখলেন, মাকালী তাঁকে আদেশ করছেন ভাগীরথীর তীরেই মন্দির প্রতিষ্ঠার। দেবীর আদেশমত রাণী রাসমণি ভাগীরথীর তীরে দেবী বিগ্রহের মন্দির প্রতিষ্ঠা করবেন বলে মনস্থির করলেন। নিজের মনোবাসনাকে বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে রাণী বজরায় চেপে প্রায় প্রতিদিন গঙ্গাবক্ষে ঘুরে বেড়াতেন। খুঁজে বেড়াতেন পছন্দের জায়গা। একদিন তিনি বজরা করে যাচ্ছিলেন শেওড়াফুলি ঘাটের দিকে। রাণী শুনেছিলেন শেওড়াফুলিতে অধিষ্ঠাত্রী নিস্তারিণী দেবী অত্যন্ত জাগ্রত। তাই নিস্তারিণী দেবী দর্শনের জন্য রাণী পাড়ি দিলেন শেওড়াফুলির পথে। ঘাটের কাছে বজরা আসতেই রাণীমা এবং মাঝিমাল্লারা দেখলেন ঘাটের কাছে দাঁড়ানো এক কিশোরী তাঁদের ডাকছেন। চারিপাশের পরিবেশ নিস্তব্ধ, নির্জন। রাণীমার আদেশ অনুসারে বজরা ভিড়ল ঘাটে। কিশোরীর মনোমুগ্ধকর রূপে রাণীমাকে মোহিত। রাণীমা কিশোরীকে নিস্তারিণী মন্দিরে যাওয়ার পথ দেখাতে বললেন। রাণীমাকে কিশোরীটি বলল, ‘আমি তো সেখানেই থাকি গো।’ রাণীমাকে বজরা থেকে নেমে আসতে বলল সে। রাণীমাও বজরা থেকে নেমে মন্ত্রমুগ্ধের মত কিশোরীকে অনুসরণ করলেন। মন্দিরের কাছাকাছি আসতেই রাণীমাকে নিস্তারিণী মায়ের থান দেখিয়ে হঠাৎ হারিয়ে গেল কিশোরীটি। তাঁর কথা ভাবতে ভাবতে রানীমা দেবীদর্শন করলেন ও পুষ্পাঞ্জলি দিলেন। রাণীমা দেবী নিস্তারিণীর মুখের দিকে তাকাতেই ঐ কিশোরীর চোখ আর হাসি ফুটে উঠল। রাণী রাসমণি তখন বুঝতে পারলেন, স্বয়ং দেবী তাঁকে দর্শন দিয়েছেন।
যাই হোক, শেওড়াফুলির এই মন্দির প্রাঙ্গণে পৌঁছতে গেলে বেশকিছু সিঁড়ি ভাঙতে হয়। বড় বড় থামওয়ালা নাটমন্দির। মন্দিরের সামনে হাড়িকাঠ। মন্দিরে পঞ্চমুণ্ডির আসনের উপর তামার বেশ বড় একটা পাপড়িওয়ালা পদ্ম। তার উপরেই দুহাত মাথার দিকে তোলা মহাদেবের বুকের ওপর বিরাজমান মা নিস্তারিণী। কষ্টিপাথরে দক্ষিণাকালী ত্রিনয়নী এলোকেশী। করুণা ভরা দৃষ্টি। দেবীমূর্তি উচ্চতায় আড়াই-তিন ফুট।
মন্দির গাত্রে পাথরের ফলকে লেখা আছে
বর্ধমান জেলার অন্তর্ভুক্ত পাটুলির দত্ত রাজবংশজাত সাড়াপুলি বা শেওড়াফুলি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা
“ক্ষত্রিয়রাজ” রাজা মনোহর রায়ের পুত্র রাজা রাজচন্দ্র রায়
রাজচন্দ্রের প্রপৌত্র রাজা হরিশ্চন্দ্র রায়
১৮২৭ খৃঃ (১২৩৪ সালে জ্যৈষ্ঠ মাসে)
এই মন্দিরে মা নিস্তারিণীকে সকালে এবং বিকেলে অন্নভোগ দেওয়া হয়না, বদলে লুচিভোগ দেওয়া হয়। প্রতি অমাবস্যায় মহাসমারোহে মায়ের পুজো হয়। ভক্তরা মনোবাসনা পূরণের উদ্দেশ্যে সেদিন বলিও দেন। কালীপুজোর দিন এই মন্দিরে অসম্ভব ভিড় হয়।