করোনার জেরে বিষাদের সুর, এবছরও নিষিদ্ধ ঐতিহ্যবাহী ইছামতির ভাসান
কয়েক বছর ধরে ইছামতীর (Ichhamati) বুকে বিজয়া দশমী উপলক্ষে দুই বাংলার মিলন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জৌলুস হারিয়ে রং ফ্যাকাসে হয়েছে ইছামতির ভাসান। এবছর করোনা পরিস্থিতির জেরে যেনো আরও বিষাদের সুর বয়ে আনল ঐতিহ্যবাহী ইছামতির ভাসান। পুজো উদ্যোক্তাদের হাতেগুনে নৌকোয় নামার অনুমতি থাকলেও দর্শনার্থীদের ক্ষেত্রে নৌকা বিহারের কোনও অনুমতি থাকছে না।
করোনা (Coronavirus) অতিমারী পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি অনুযায়ী গত বছরের মতো এবছরও পুজোয় যেমন অতি-কড়াকড়ি, তেমনই ইছামতিতে ভাসানের ক্ষেত্রেও থাকছে নিয়মের কড়াকড়ি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে টাকির ইছামতী নদীতে বিসর্জনের প্রতিমার নৌকা জলে নামলেও দর্শনার্থীদের ক্ষেত্রে থাকছে নিষেধাজ্ঞা। একই নিয়ম ওপার বাংলার ক্ষেত্রেও। সম্প্রতি ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (BSF) ও বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (BGB) তরফে ফ্ল্যাগ মিটিংয়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও স্থানীয় প্রশাসন ও পুরসভার তরফে নেওয়া হয়েছে বাড়তি সতর্কতা।
টাকি পুরসভার প্রশাসক সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় জানান, “প্রতিমা নিয়ে যে সমস্ত পুজো কমিটি নৌকায় উঠবে তাদের ক্ষেত্রেও কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। যেমন আট থেকে দশ জনের বেশি প্রতিমার নৌকায় উঠতে পারবে না। বিসর্জনের জন্য নির্দিষ্ট যে যে ঘাট চিহ্নিত করা হয়েছে শুধুমাত্র সেই সমস্ত ঘাটগুলো থেকেই বিসর্জনে প্রতিমা নামানো যাবে। এছাড়াও ভাসানের ক্ষেত্রে দুপুর ১ টা থেকে বিকেল ৪ টে পর্যন্ত বেঁধে দেওয়া হয়েছে নির্দিষ্ট সময়ও।”
অন্যদিকে, বসিরহাট পুরসভা এলাকায় ভাসানের রাখা হয় কড়া বিধি। সময় নির্দিষ্ট করে না দেওয়া হলেও প্রতিমার নৌকায় ৮ থেকে ১০ জনের বেশি উঠতে পারবে না। ইচ্ছামতীর জলে নামতে পারবে না। দর্শনার্থী থেকে শুরু করে পর্যটকদের নৌকা। পাড়ে দাঁড়িয়েই ভাসান উপভোগ করতে হবে তাদের। ভিড় এবং জমায়েত এড়াতে কোনও ভাবেই ঝুঁকি নিতে চাইছে না দুই পুরসভাই।
দীর্ঘ ২৫০-৩০০ বছর ধরে ভারত বাংলাদেশ (Bangladesh) সীমান্তের উত্তর ২৪ পরগনার ইছামতী নদীতে ভাসান উপলক্ষে মিলেমিশে একাকার হয়ে এসেছে দু’বাংলা। ভাসান উপলক্ষে বিজয়ার দিন একত্রিত হতে পারত একপারে টাকি, হাসনাবাদ, বসিরহাট, হিঙ্গলগঞ্জ আর ওপারে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, ঘলঘলে, শ্রীপুর, পারুলিয়ার মতো গ্রাম ছাড়াও এই ভাসানে অংশ নিতেন ঢাকা থেকে আসা মানুষও। পরস্পরকে উপহার দেওয়ার মাধ্যমে গড়ে ওঠত এক অনাবিল সৌহার্দ্যের পরিধি। ২০১১ পর্যন্ত এইভাবেই মিলেমিশে গেছে দুই বাংলা।
কিন্তু ২০১২ সাল থেকে বন্ধ হয়ে গিয়েছে ইছামতীর বুকে দুই বাংলার মিলন পর্ব। ইছামতীর ভাসান দেখতে এসে নদীতে নৌকা উলটে মৃত্যু হয় সুজয় দাস নামে যাদবপুরের এক গবেষকের। এছাড়াও অনুপ্রবেশের জেরেই চুরি ডাকাতির ঘটনা বেড়েছে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক এবং রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ টাকির বাসিন্দাদের। যার ফল স্বরূপ ২০১২তে সীমান্তে বেড়ে যায় কড়াকড়ি। বন্ধ হয়ে যায় বিসর্জন পর্ব।
তবুও একদিনের জন্য ইছামতী নদীর বুকে দুই বাংলা যেভাবে নৌকায় নামত, জলসীমা অতিক্রম না করেই হত দুই বাংলার ভাসান। বিসর্জনের সঙ্গে টাকি রাজবাড়ি, মাছরাঙা দ্বীপ, মিনি সুন্দরবনের মতো জায়গাগুলিও ঘুরে দেখে যান দেশ-বিদেশের পর্যটকরা। কিন্তু এবছর করোনার প্রভাবে তা হচ্ছে না। যে মাঝিরা বছরভর অপেক্ষায় থাকেন পর্যটক এবং সাধারণ মানুষকে নৌকায় ভ্রমণ করানোর জন্য। এবার তাদের মাথায় হাত। আশাহত বসিরহাটের মানুষও।